Decision Maker

পিপলস লিজিংয়ের সম্পদ-দায়: শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীদের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া এবং পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ হওয়া পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) সম্পদের পরিমাণ নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে পিপলস লিজিংয়ের সম্পদের পরিমাণ তিন হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির আমানত আছে দুই হাজার ৩৬ কোটি টাকা। তাই আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

তবে চলতি বছরের মার্চ শেষে কোম্পানিটির তৈরি করা আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পিপলস লিজিংয়ের মোট সম্পদ আছে এক হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আমানত রয়েছে এক হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে আমানত থেকে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ কম রয়েছে ৬৯৮ কোটি টাকা।

অর্থাৎ তিন মাসে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ কমেছে এক হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসে এ বিশাল অঙ্কের সম্পদ কীভাবে উধাও হয়ে গেল সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও এমন তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, পিপলস লিজিংয়ের প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে অনেক ক্ষেত্রে ঘাপলা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সম্পদের পরিমাণ এক এক জায়গায় এক এক রকম দিয়েছে। সম্পদ কোথাও বেশি দেখিয়েছে, আবার কোথাও কম দেখিয়েছে। বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা আরও করুণ।

তিন মাসের ব্যবধানে মোটা অঙ্কের সম্পদ কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সংবাদ সম্মেলনে আমরা যে তথ্য দিয়েছি সেটা ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের। এখন যদি তিন মাসে বড় অঙ্কের সম্পদ কমে যায়, সেজন্য প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদকে জবাবদিহি করতে হবে।

তিনি বলেন, সম্পদের যে চিত্রই থাকুক পিপলস লিজিংয়ের বিষয়ে এখন সিদ্ধান্ত দেবে আদালত। নিয়ম অনুযায়ী আদালতের নির্দেশনায় একটি বিশেষ নিরীক্ষা হবে। সেই নিরীক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত সম্পদের চিত্র উঠে আসবে। পরিচালকরা যদি অল্প সময়ের মধ্যে সম্পদ সরিয়ে থাকে তাহলে আদালত তাদের ছাড় দেবেন না।

পিপলস লিজিং অবসায়ন হচ্ছে- গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশ হলে প্রতিষ্ঠানটির আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। অনেক আমানতকারী টাকা ফেরত পেতে প্রতিষ্ঠানটির মতিঝিল ও গুলশান কার্যালয়ে ভিড় করেন। অপরদিকে পুঁজিবাজারে শেয়ারের ব্যাপক দরপতন হয়। দফায় দফায় দাম কমিয়েও শেয়ারের ক্রেতা খুঁজে পাননি বিনিয়োগকারীরা।

এ পরিস্থিতিতে গত ১০ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, পিপলস লিজিং অবসায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমানতকারীদের শঙ্কার কিছু নেই। কারণ প্রতিষ্ঠানটির আমানতের তুলনায় সম্পদের পরিমাণ বেশি। তাদের আমানতের পরিমাণ দুই হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বিপরীতে সম্পদ আছে তিন হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।

এদিকে চলতি বছরের মার্চ শেষে কোম্পানিটির তৈরি করা আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শেয়ারহোল্ডারদের দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৩১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এতে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ টাকা ৬৬ পয়সা। অর্থাৎ অবসায়ন হলে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ারহোল্ডাররা কোনো টাকাই পাবেন না।

আর্থিক অবস্থার এমন দুরবস্থার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতকারীদের শঙ্কিত না হওয়ার জন্য সান্ত্বনা দিলেও পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দরপতন ও ক্রেতাশূন্য অব্যাহত থাকে। ফলে রোববার (১৪ জুলাই) থেকে কোম্পানিটির শেয়ার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।

এ বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, শেয়ারের দাম কমে গেলে কোনো একটি চক্র শেয়ারটি কিনে নিতে পারে। আর যদি কোনো গ্রুপ বেশির ভাগ শেয়ার কিনে নেয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক শর্তসাপেক্ষে কোম্পানিটিকে আবার ব্যবসা করার সুযোগ দেয়, তাহলে শেয়াহোল্ডাররা মার খেয়ে যাবে। কাজেই কোনো সিদ্ধান্ত পার্মানেন্ট (স্থায়ী) না আসা পর্যন্ত লেনদেন বন্ধ থাকাই ভালো।

পিপলস লিজিং বন্ধ হয়ে গেলে শেয়ারহোল্ডাররা কী পাবেন? এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আইন অনুযায়ী সমস্ত সম্পদ বিক্রির পর আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার পর কিছু থাকলে তা শেয়ারহোল্ডাররা সমানভাবে ভাগ করে নেবেন। তবে দায় থাকলে শেয়ারহোল্ডারদের তা পরিশোধ করতে হবে না। কারণ লিমিটেড কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারের দায় শেয়ার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলে দেয়া হলো আমানতের থেকে পিপলস লিজিংয়ের সম্পদ বেশি আছে, তাই আমানতকারীদের শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ধরেই নিলাম প্রতিষ্ঠানটির আমানতের থেকে সম্পদ বেশি আছে। কিন্তু এ সম্পদ বিক্রি করতে গেলে কি ওই দাম পাওয়া যাবে? কোনো চক্র তো সিন্ডিকেট করে কম দামে সম্পদ কিনে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কী করবে?

পিপলস লিজিং অবসায়নের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ২০১৪ সালে তদন্ত করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য আমরা জানতে পারি। যেখানে পরিচালনা বোর্ডের অনেক সদস্যের অনিয়ম পাওয়া যায়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিয়ে পরিচালনা বোর্ড ভেঙে নতুন বোর্ড গঠন করে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়।

এত কিছুর পরও প্রতিষ্ঠানটির উন্নতি করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের জন্য আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেই। গত ২৬ জুন মন্ত্রণালয় অবসায়ন করতে অনুমতি দেয়। পরে অবসায়নের জন্য আদালতে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আমানতকারীরা কত দিনের মধ্যে অর্থ ফেরত পাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়ার পর থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমরা দ্রুত এ কার্যক্রম সম্পন্ন করব। যেহেতু আদালতে যাচ্ছি, এটা এখন আদালতের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা আমানতকারীদের অর্থ যত দ্রুত সম্ভব দেয়ার চেষ্টা করব।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পিপলস লিজিংয়ে ঋণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা, সম্পত্তির ঝুঁকি ও তারল্য সংকট রয়েছে। তারা আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ (৩) এবং ২৯ ধারায় প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়।

সম্মতি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২৬ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ অবসায়ন প্রক্রিয়া শুরু করে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটিতে আটকে থাকা আমানতের পরিমাণ, অনিয়মের ধরন, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা এবং মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু করে।

পিপলস লিজিংয়ের শেয়ারের দামের চিত্র

১৯৯৭ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০০৫ সালে। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম এক হাজার ২৫৮ টাকায় পৌঁছে যায়। ২০১০ সালের মহাধস এবং ২০১১ সালে শেয়ারের ফেসভ্যালু ১০ টাকা করার পরও প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ১১৮ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। তবে ২০১৩ সালে এসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দামে বড় ধরনের পতন হয়। ওই বছর শেয়ারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ২৭ টাকা ৯০ পয়স। এরপর প্রতি বছরই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমেছে। ২০১৪ সালের পর থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে না পরা কোম্পানিটির শেয়ারের দাম গত ১১ জুলাই লেনদেন শেষে দাঁড়ায় মাত্র ৩ টাকায়। এমন পানির দামেও কোম্পানিটির শেয়ার কেউ কেনার আগ্রহ দেখাননি।

২৮৫ কোটি ৪৪ লাখ ১০ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ২৮ কোটি ৫৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৯৭টি। শেয়ারের ৬৭ দশমিক ৮৪ শতাংশই রয়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। বাকি শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে।

আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পাশাপাশি গত দেড় বছরে পিপলস লিজিংয়ের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা প্রতিষ্ঠানটির মোটা অঙ্কের শেয়ার বিক্রিও করে দিয়েছেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ছিল ২৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ দেড় বছরের মধ্যে উদ্যোক্তারা ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বা প্রায় দুই কোটি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।

আইনে যা বলা আছে

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ (৩) ধারা অনুযায়ী, আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষায় যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোম্পানি আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের ভিত্তিতে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের জন্য আদেশ দিতে পারবে।

একই আইনের ৮ ধারায় যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন কারণে যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে আমাতকারীদের স্বার্থহানি হয় এমনভাবে ব্যবসা করা, দায় পরিশোধে অপর্যাপ্ত সম্পদ, অবসায়ন বা কার্যক্রম বন্ধ, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ ইত্যাদি।

অর্থ ফেরতের বিষয়ে আইনে যা আছে

সংশ্লিষ্টরা জানান, অবসায়ন হওয়া প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর অর্থ কোন উপায়ে ফেরত দেয়া হবে, সে বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে আদালত যে উপায়ে অর্থ পরিশোধ করতে বলবেন, তা কার্যকর হবে। তবে সাধারণভাবে সম্পদ বিক্রি এবং সরকারের সহায়তার আলোকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া হয়। এজন্য প্রথমে প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদ নিরূপণ করা হয়। এরপর একটি স্কিম ঘোষণা করা হয়। যেখানে নির্দিষ্ট মেয়াদ উল্লেখ করে কোন পরিমাণ আমানত কবে নাগাদ পরিশোধ করা হবে তার উল্লেখ থাকে।

Exit mobile version