পুঁজিবাজার উন্নয়নে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে (২০১৯-২০২০) সরকার যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বিনিয়োগকারীদের জন্য করমুক্ত ডিভিডেন্ড আয় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা প্রতিষ্ঠা করতে অনিবাসী কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ড আয়ের ওপর দ্বৈতকর প্রত্যাহার এবং পুঁজিবাজারের গতিশীলতা ফেরাতে যেসব উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে তাতে এই মার্কেটে প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য যে ৪টি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে দুটি বিষয় পুন:বিবেচনার দাবি উঠেছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে নগদ লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহ দিতে স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর ১৫ শতাংশ কর এবং যদি কোনো কোম্পানির রিটেইনড আর্নিংস, রিজার্ভ ইত্যাদি তার পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রে বাড়তি ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। শেয়ারবাজারের এক পক্ষ এ দু’টি বিষয়কে বেশ ইতিবাচক দেখলেও আরেক পক্ষ দেখছেন বেশ নেতিবাচকভাবে। আর এই মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় মার্কেটও যাচ্ছে নেতিবাচক দলের দিকে।
যারা বিষয় দু’টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তাদের যুক্তি হলো, গেল কয়েক বছর ধরে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো স্টক ডিভিডেন্ডের নামে বিনিয়োগকারীদের কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছে। কোম্পানির পেইড-আপকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন অবস্থা তৈরি করেছে যে এই কোম্পানিগুলো আর ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না। থিউরিটিক্যাল অ্যাডজাস্টমেন্ট হতে হতে এগুলোর শেয়ার দর তলানিতে এসে ঠেকেছে। যেমনটি হয়েছে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের স্টক ডিভিডেন্ড দেওয়ার রীতি চালু করে।
এছাড়া ডিভিডেন্ড না দিয়ে কোম্পানিগুলো তাদের রিজার্ভ ও সারপ্লাস বৃদ্ধি করছে। যে পরিমাণ আয় হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম ডিভিডেন্ড দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাই কোম্পানিগুলোকে দায়িত্বশীলতার মধ্যে আনতে এই ট্যাক্স আরোপ যথাযথ হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কিছুটা হলেও ক্যাশ ডিভিডেন্ড পাবেন। যদিও এটি দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসু হবে না তবে কোম্পানিগুলোকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে সাময়িকভাবে এই প্রাকটিস থাকা উচিত।
এদিকে স্টক ডিভিডেন্ড ও রিটেইনড আর্নিংস-রিজার্ভের ওপর কর বসানোর প্রস্তাব মোটেও শেয়ারবাজারের জন্য প্রণোদনা নয় বরং এটি দীর্ঘমেয়াদে শেয়ারবাজারকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে এমনটা মনে করছে অনেকেই। তাদের যুক্তি হলো, শেয়ারহোল্ডারদের ভালো লভ্যাংশ দেওয়ার পরই কোম্পানিগুলো রিটেইনড আর্নিংস রাখছে। আর ঝুঁকি মোকাবেলা ও ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যেই কোম্পানিগুলো রিজার্ভ রাখে। যেহেতু কোম্পানির টাকা কারো ব্যক্তিগত খাতে ব্যবহারের সুযোগ নেই তাই কোম্পানি বড় হলে শেয়ারহোল্ডারদের বুক ভ্যালুই বৃদ্ধি পায়। যদি এই প্রস্তাবটি আইন আকারে পরিণত হয় তাহলে তালিকাভুক্ত ২০৯ কোম্পানিকে ১০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকার কর দিতে হবে। এর মধ্যে এমনও কোম্পানি রয়েছে যাদের ১০০ কোটি থেকে ৭০০ কোটি টাকা পর্যন্ত কর দিতে হবে। আর কোনো কোম্পানিরই রিজার্ভের টাকা কোম্পানির অ্যাকাউন্টে পড়ে নেই। সব টাকাই ব্যবসার কাজে লাগানো রয়েছে। যদি কর দিতে হয় তাহলে কোম্পানিকে তার অ্যাসেট বিক্রি করে টাকা দিতে হবে। আর এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। সরকার যে ট্যাক্স আরোপ করার চিন্তা করেছে সেই ট্যাক্সের টাকা কোম্পানির কাছ থেকে নিয়ে নিশ্চয়ই বিনিয়োগকারীদের ফেরত দেবে না। এই সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের একাত্মতা প্রকাশ করা হবে আত্মঘাতী।
এদিকে স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর করারোপ করা হলে সবচেয়ে বেশি হুমকির মধ্যে পড়বে ব্যাংক খাত। তারপর ম্যানুফ্যাকচারিং ও পুঁজিবাজারেরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া এটি প্রণয়ন করতে হলে অ্যাকাউন্টিং সিস্টেমেও পরিবর্তন আনতে হবে। পুঁজিবাজারকে টেনে তুলতে স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর করারোপের সিদ্ধান্তে ব্যাংকের ওপর যে বাড়তি চাপ পড়বে, সেটা বিবেচনা করা হয়নি। আর ব্যাংকের প্রাইমারি রেগুলেটর যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক তাই এ বিষয়ে সংস্থাটির মন্তব্য খুবই জরুরি। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য উল্লেখিত প্রণোদনার বিষয়ে ঢালাওভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। আর যেহেতু স্টক ডিভিডেন্ড প্রদান করলে তার ব্যবহার সম্পর্কে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বিএসইসি’র নির্দেশনা রয়েছে তাই এ বিষয়ে বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া সমীচীন হবে না। বরং ক্যাশ ডিভিডেন্ড প্রদানে কর অব্যাহতি দেওয়া হলে তা হতো সত্যিকারের শেয়ারবাজারের প্রণোদনা।
এমনিতেই এতো ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও বাজারকে স্থিতিশীল করা যাচ্ছে না। তারওপর বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়ে বাজারকে ভালো করা যাবে এমনটা ভাবা যুক্তিযুক্ত নয়। যেহেতু এটি প্রস্তাবিত বাজেট এবং কমিশন নিজে বলেছে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। তাই চূড়ান্ত বাজেটে এই বিতর্কিত বিষয়ের সমাধান করা হবে তেমনটাই আশা করছে বাজার সংশ্লিষ্টরা।