জাতীয় সংসদে আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের “সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের” শীর্ষক বাজেট পাশ হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট এটি। স্বাধীনতার পর এবারই সর্ববৃহৎ ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট পাশ করেছে সরকার।
আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য ৪টি চুড়ান্ত প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুঁজিবাজারকে গুরুত্ব দিয়ে প্রণোদনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি উন্নয়নে করণীয় সবই সরকারের পক্ষ থেকে বাস্তবায়ন করা হবে বলে বলা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য পুঁজিবাজারে যেসব প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ:
স্টক লভ্যাংশের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান:
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে স্টক লভ্যাংশ দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এতে বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই ক্যাশ লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহিত করতে স্টক লভ্যাংশের ওপর ১০ শতাংশ করারোপ করা হবে। বাজেটে এ সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীগণ কোম্পানি থেকে ক্যাশ লভ্যাংশ প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেন। সে বিবেচনায় ক্যাশ লভ্যাংশ প্রদান পুঁজিবাজারে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি ও পুঁজিবাজার শক্তিশালীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ক্যাশ লভ্যাংশের পরিবর্তে স্টক লভ্যাংশ তথা বোনাস শেয়ার বিতরণের প্রবণতা কোম্পানিসমূহের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এতে বিনিয়োগকারীগণ তাদের প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। স্টক লভ্যাংশের পরিবর্তে ক্যাশ লভ্যাংশ প্রদানকে উৎসাহিত করার জন্য কোনো কোম্পানি স্টক লভ্যাংশ প্রদান করলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে উক্ত স্টক লভ্যাংশের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করতে হবে। উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত বাজেটে স্টক লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ ট্যাক্সারোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
পরিশোধিত মূলধনের ৭০ শতাংশের বেশি রিটেইনড আর্নিংস, রিজার্ভের ওপর ১০% ট্যাক্সারোপ:
কোম্পানির অর্জিত মুনাফা থেকে শেয়ার হোল্ডারগণ তথা বিনিয়োগকারীদেরকে লভ্যাংশ দেওয়ার পরিবর্তে রিটেইনড আর্নিংস বা বিভিন্ন ধরণের রিজার্ভ হিসাবে রেখে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এতে প্রত্যাশিত লভ্যাংশ প্রাপ্তি থেকে বিনিয়োগকারীগণ বঞ্চিত হচ্ছেন এবং পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ধরণের প্রবণতা রোধে করা প্রয়োজন। এজন্য কোনো কোম্পানির কোনো আয় বছরে রিটেইনড আর্নিংস, রিজার্ভ ইত্যাদি সমষ্টি যদি পরিশোধিত মূলধনের ৭০ শতাংশের বেশি হয় তাহলে যতটুকু বেশি হবে তার ওপর সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে ১০ শতাংশ কর প্রদানের বিধান করা হয়েছে।
অর্থাৎ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি, কোনো অর্থবছরে কর পরবর্তী নিট লাভের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ রিটেইন আর্নিংস ফান্ড, রিজার্ভ সারপ্লাস ইত্যাদিতে স্থানান্তর করতে পারবে। অর্থাৎ কোম্পানিকে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ ষ্টক ও ক্যাশ দিতে হবে। যদি কোনো কোম্পানি এভাবে ব্যর্থ হয় তাহলে প্রতিবছর রিটেইন আর্নিংস ফান্ড, রিজার্ভ, সারপ্লাস এ স্থানান্তরিত মোট অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে।
লভ্যাংশ আয়ের করমুক্ত সীমা ৫০ হাজার টাকা:
২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ আয়ের করমুক্ত সীমা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী তথা সামগ্রিক পুঁজিবাজার উন্নয়নে এই করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। অর্থাৎ তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ আয় ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কোনো ট্যাক্স দিতে হবে না আগে যা ছিলো ২৫ হাজার টাকা।
অনিবাসী কোম্পানির লভ্যাংশ আয়ের ওপরও দ্বৈতকর প্রত্যাহার:
গেল বছরের বাজেটে দেশিও বা নিবাসী কোম্পানির লভ্যাংশ আয়ের ওপর দ্বৈতকর প্রত্যাহার করা হয়েছে। এবারের বাজেটে (২০১৯-২০২০) বহুজাতিক কোম্পানি বা অনিবাসী কোম্পানির লভ্যাংশ আয়ের ওপরও দ্বৈতকর প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের উৎসাহী করার জন্য এ বছর নিবাসী ও অনিবাসী সকল কোম্পানির ক্ষেত্রে লভ্যাংশ আয়ের ওপর একাধিকবার করারোপন (Multi layer Taxation on Dividend) রোধ করার বিধান করা হয়েছে।
টেক্সটাইল খাতে রপ্তানি প্রণোদনাঃ
প্রস্তাবিত বাজেটে তৈরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে চারটি খাত (ওভেন, নিট, সোয়েটার ও টেক্সটাইল) ৪% হারে প্রণোদনা পাচ্ছে সেগুলোর বাইরে থাকা অন্য সব খাতকে ১% হারে প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়অ হয়েছে। এজন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে আরও দুই হাজার ৮২৫ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বীমার ব্যবহার বৃদ্ধিঃ
কৃষকদের জন্য পাইলট প্রকল্প হিসাবে শস্য বীমা এবং গবাদিপশু বীমা চালু করা করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের গ্রুপ বীমার আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আবাসান খাতে কালো টাকা বিনিয়োগে কর হ্রাস এবং জমি, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনে ডিউটি এবং ফি কমানোঃ
আবাসান খাত তথা প্লট ও ফ্ল্যাটে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) বিনিয়োগের সুযোগ আগে থেকেই ছিল। তবে কালো টাকা বিনিয়োগে করহার বেশি ছিল যা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আবাসান খাতে স্ট্যাম্প ডিউটি এবং রেজিস্ট্রেশন ফি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আইটি এবং টেলিকমিউনিকেশন খাতে শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধিঃ
স্মার্ট ফোনের আমদানিতে শুল্ক ১০% থেকে বৃদ্ধি করে ২৫% করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আইসিটি খাতের বিভিন্ন উপকরন আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে অথবা অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের মাধ্যমে প্রদত্ত সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ৫% থেকে বৃদ্ধি করে ১০% করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমের মোবাইল কল রেট এবং মোবাইল সিমের মাধ্যমে ব্যবহৃত ইন্টারনেটের দাম বাড়তে পারে।
চামড়া ও পাদুকা শিল্পের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক হ্রাসঃ
চামড়া ও পাদুকা শিল্পের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঔষধ শিল্পে প্রণোদনা এবং শুল্ক হ্রাসঃ
ক্যান্সার প্রতিরোধক ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মেডিক্যাল গ্যাস প্রস্তুতকারী কাঁচামালের উপর ডিউটি ২০% থেকে কমিয়ে ১০% করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া তামাকজাত পন্যে ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে। মোটরসাইকেল আমদানি নিরুৎসাহিত করে দেশীয় মোটরসাইকেল উৎপাদন উৎসাহিত করতে উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণের শুল্ক বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, আজ (০১ জুলাই) থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট কার্যকর হবে।