পুঁজিবাজারের প্রাণ বিনিয়োগকারী। কিন্তু বাজারের মন্দাবস্থার কারণে ক্রমাগত কমছে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বেশি হলেও তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম। ছোট ছোট জমানো অর্থ বাড়তি মুনাফার আশায় তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কম হলেও বিনিয়োগ অনেক বেশি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর হাতে মূলধনের বড় জোগান থাকলেও বাজারে তারা নিষ্ক্রিয়। প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ও প্রণোদনার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা পেলেও তাদের এই নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।

প্রাতিষ্ঠানিকরা প্রশ্নের জবাবে বলছে, বড় কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক থেকে মূলধন ধার নিয়ে ব্যবসা করে তারা। কারো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি বেড়ে যাওয়ায় তারল্য সংকটে তাদের বিনিয়োগের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। “ফান্ড ক্রাইসিস” চলছে, “ফ্রেশ” ফান্ড বাজারে আসছে না। আবার পুঁজিবাজারের মন্দাবস্থায় শেয়ারের দাম তলানিতে নামায় কারো কারো মূলধনও আটকে গেছে।

এদিকে পুঁজিবাজার সাপোর্টে রাষ্ট্রায়ত্ত ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ভূমিকা নিয়েও নানামুখী প্রশ্ন ঘুরছে সবখানেই। বাজার গতিশীল রাখতে সরকার থেকে আইসিবি কোটি কোটি টাকার ফান্ড পেলেও তাদের সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে স্টেকহোল্ডাররা।

আইসিবি বলছে, সেকেন্ডারি মার্কেটের শেয়ারের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য রাখতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে আইসিবির ১১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক প্রতিবেদনে জানানো হয়। বাজার সাপোর্ট দিতে নতুন করে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ চেয়েছে তারা। তবে তা না দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনা স্কিমের সাড়ে আট কোটি টাকা মূলধন দিয়েছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। সেই তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নগণ্য। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী যেখানে লাখ টাকার বিনিয়োগ করে, সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ কোটি টাকার ওপরে। এই প্রাতিষ্ঠানিকরা পুঁজিবাজারে সক্রিয় হলে বাজারের চিত্র পাল্টে যায় আর নিষ্ক্রিয় থাকলে মন্দা নেমে আসে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ২৫ লাখ ২১ হাজার। যার মধ্যে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী ১৬ লাখ আর যৌথ বিনিয়োগকারী ৯ লাখের বেশি। দেশীয় বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব রয়েছে ২৩ লাখ ৭৮ হাজার, আর দেশীয় কিন্তু বিদেশে অবস্থান করছে এমন বিও হিসাবধারী এক লাখ ৪২ হাজার। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ছয় শতাধিক।

ব্যক্তি বিনিয়োগের বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে তারাই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য বা ব্রোকারেজ হাউস, স্টক ডিলার ও স্টক ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংক, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, কাস্টডিয়ান, ট্রাস্টি ও ফান্ড পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচিত। এর বাইরে দেশের বাণিজ্যিক বা তফসিলি ব্যাংকও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্রে জানা যায়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সদস্যরা সাধারণ বিনিয়োগকারীর শেয়ার কেনাবেচার পাশাপাশি নিজেরাও প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিনিয়োগ করে। দুই স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য ৩৯৭ জন, যাদের ডিএসইতে স্টক ডিলার ২২৯ জন ও সিএসইতে ১২১ জন। স্টক ব্রোকার ডিএসইতে ২৪৫ জন আর সিএসইতে ১৫২ জন। বাজারে মার্চেন্ট ব্যাংক ৬২টি, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ৪৩টি, ট্রাস্টি কোম্পানি ১০৩টি, ফান্ড ম্যানেজার ১৬টি, কাস্টডিয়ান ১৯টি আর ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি আটটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতের অস্থিরতার কারণে প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও অর্থ সংকটে ভুগছে। অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বড় কোনো ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান। মূল ব্যাংক তারল্য সংকটে হিমশিম খাওয়ায় বাজারের মন্দাবস্থায় পুঁজিবাজারে ব্যবসার জন্য ঋণ দিচ্ছে না। ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়ায় প্রাতিষ্ঠানিকরাও সেভাবে এগোতে পারছে না।

কোম্পানি আইন অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নির্দিষ্ট করা আছে। সাবসিডিয়ারিকে ঋণ দিলেও সেটা এক্সপোজারের মধ্যে এত দিন গণনা করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সিদ্ধান্তে ব্যাংকের বিনিয়োগের সক্ষমতা বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেও নতুন করে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ আসেনি।

জানা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সংখ্যায় কম হলেও বড় বিনিয়োগের কারণে পুঁজিবাজার গতিশীল রাখতে তারা সুযোগ-সুবিধা পায়। কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) শেয়ার বরাদ্দ পেতে কোটা সুবিধা পায় তারা। স্থির মূল্য বা অভিহিত মূল্য ১০ টাকায় একটি কোম্পানি ১০০ কোটি টাকা মূলধন উত্তোলন করলে ৩০ কোটি টাকার শেয়ার বরাদ্দ পাবে ছয় শতাধিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আর ৫০ কোটি টাকার শেয়ার বরাদ্দ পাবে ২০ লাখের বেশি সাধারণ বিনিয়োগকারী।

বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কোনো কোম্পানি ১০০ কোটি টাকার মূলধন উত্তোলন করতে চাইলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কোটা ৫০ শতাংশ অর্থাৎ তারা ৫০ কোটি টাকার শেয়ার কিনতে পারবে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পাবে ৪০ কোটি টাকার শেয়ার।

আইপিওতে শেয়ার বরাদ্দে কোটা সুবিধার সুবিধা হচ্ছে কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার পর শেয়ার লেনদেন শুরু হলে ওই শেয়ার কিনতে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর আগ্রহ বাড়লে দামও বেড়ে যায়। প্রাথমিক মার্কেটে আইপিওতে বরাদ্দ পাওয়া শেয়ারের দাম বেড়ে গেলে সেই শেয়ার বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা মুনাফা করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিকরা পুঁজিবাজারের বড় বিনিয়োগকারী কিন্তু তারা সঠিক ভূমিকা পালন করছে না। বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তাদের সঠিক ভূমিকা বাজারে নেই। কারণে তাদের মধ্যে সে ধরনের ম্যাচুরিটি দেখা যায়নি।

তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর ভূমিকা সঠিক হলে বাজারের অবস্থা এমন হতো না। তবে তারা কেন এমন করছে সেটা জানা নেই। আশা করছি ভবিষ্যতে তাদের কাছ থেকে যথাযথ ভূমিকা পাব। কারণ তারা বড় বিনিয়োগকারী, তাদের দেখে অনেকে বিনিয়োগ করে। আর তারা না থাকলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও বিমুখ হয়।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজার মধ্যস্থতাকারীর পাশাপাশি বড় বড় ব্যাংকও প্রাতিষ্ঠান হিসেবে বিনিয়োগ করে। আর নতুন আইপিও বাজারে এলে তাদের জন্য বিশেষ কোটা ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাজারে তাদের সক্রিয়তা বাড়লে বাজার ভালো হবে।

এমটিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের সিইও খায়রুর বাশার মোহাম্মদ আবু তাহের সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ব্যাংক খাতের আর্থিক সংকটের প্রভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয়। তাদের হাতে নতুন অর্থ নেই। বাজারে ফ্রেশ মানি আসছে না। যাদের মূলধন বিনিয়োগ করা আছে, সেগুলোই কেনাবেচা করে চলতে হচ্ছে। অনেকের কেনা শেয়ারের দাম কমে যাওয়ায় লোকসানেও বের হতে পারছে না। সব মিলিয়ে একটা সংকটের মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।

তিনি বলেন, বাজারে মন্দাবস্থার কারণে অনেক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বড় বিনিয়োগকারীরা সাধারণত দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করে। কিন্তু হাতে অর্থ না থাকায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর মতো দৈনিক লেনদেন করে চলতে হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অর্থ সরবরাহের সুযোগ সৃষ্টি না করলে সক্রিয় হওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বাজার সাপোর্ট দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে স্কিমের আওতায় অর্থ বরাদ্দেরও দাবি জানান তিনি।