তিন বছর ধরে প্রায় একই রকম আছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। যদিও বেড়ে গেছে আমদানি। তিন বছর আগেও যেখানে সাত মাসের বেশি আমদানি দায় পরিশোধের সক্ষমতা ছিল রিজার্ভের, এখন তা পাঁচ মাসের নিচে নেমে এসেছে। বড় প্রকল্পের জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা পুরোপুরি শুরু হলে এ সক্ষমতা আরো কমবে। বড় প্রকল্পগুলোর জন্য নেয়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ রিজার্ভের এ সক্ষমতা আরো কমিয়ে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের গ্রস ও নিট—দুই ধরনের পরিসংখ্যান তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্পদ থেকে দায় বাদ দিয়ে নিট রিজার্ভ হিসাব করা হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময়ই গ্রস রিজার্ভের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো রিজার্ভের নিট হিসাবকে প্রকৃত রিজার্ভ হিসেবে গণ্য করে।

আইএমএফের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুনে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে নিট রিজার্ভ ছিল প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার। এর পর থেকে গ্রস রিজার্ভ ওঠানামার মধ্য দিয়ে গেছে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর পর থেকে ৩১ থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বৃত্তে ওঠানামা করছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে নিট রিজার্ভ ছিল ২৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কম আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যাবে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভের সক্ষমতা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সংস্থাটি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি হলো যেকোনো পণ্যের মূল্য বাজারভিত্তিক হওয়া। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখার কথা বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। রিজার্ভে থাকা ডলার বিক্রি করে বাজার স্থিতিশীল রাখার পথে হেঁটেছে। ফলে ডলারের বাজারমূল্যের সঙ্গে নমিনাল ইফেক্টিভ রেট (নিয়ার) ও রিয়াল ইফেক্টিভ রেটের (রিয়ার) মধ্যে বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এভাবে বিক্রি করতে থাকলে একসময় রিজার্ভ তলানিতে নামবে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমদানি নিরুৎসাহিত করে রফতানি ও রেমিট্যান্সকে উৎসাহিত করা দরকার।

বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা বিনিময় হার নীতির পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের সমস্যার কারণে দেশের রিজার্ভ কমছে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। দুই বছরেই রিজার্ভ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ শূন্য হয়ে যাবে। তখন বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কী করবে?

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ফোন করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা শুভ লক্ষণ নয়। আমদানি যে পরিমাণ হচ্ছে, তার বিপরীতে রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি শ্লথ। দেশে চলমান বৃহৎ প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী, এ প্রকল্পগুলোতে নেয়া বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। তখন ডলারের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। এজন্য সময় থাকতেই ডলারের রিয়েল এক্সচেঞ্জ রেটের সঙ্গে বাজারদরের সমন্বয় করতে হবে। আমদানিকে উৎসাহিত করে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল করা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশ থেকে ৩ হাজার ৯০ কোটি ডলারের রফতানি হয়েছে। একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ১৮৬ কোটি ডলার। যদিও জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৯ কোটি ডলারের আমদানি হয়েছে। বিশাল এ আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়েই ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে দেশের চলতি হিসাবে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৬৯ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতির কারণে চলতি হিসাবে ৪২৭ কোটি ডলার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ঘাটতি ছিল ব্যালান্স অব পেমেন্টেও। বৃহৎ প্রকল্পগুলোর জন্য নেয়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে এ ঘাটতি আরো বাড়বে।

এছাড়া ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে দুই বছর ধরেই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার বিক্রিতেই সমাধান খুঁজছে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

তবে রিজার্ভ নিয়ে এখনই শঙ্কা নেই বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, একসময় তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করার মতো ডলার রিজার্ভে থাকলেই আমরা খুশি থাকতাম। সেদিক বিবেচনায় বর্তমান রিজার্ভ খারাপ না। ২০১২ সালের পরবর্তী সময়ে রিজার্ভের অর্থের প্রবৃদ্ধি অনেকটাই অস্বাভাবিক ছিল। সে সময় আমদানিতে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। একই সময়ে ডাবল ডিজিটের রফতানি ও রেমিট্যান্সে উচ্চপ্রবৃদ্ধির কারণে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে। গত দুই বছরে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় খারাপ ছিল। আশার কথা হলো, চলতি অর্থবছরে দুটি খাতই কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

যদিও বৈদেশিক মুদ্রা স্থিতিশীল রাখতে বাজার পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সংশোধনের সুযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করেন ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, আঙুর, আপেলের মতো অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি উৎসাহিত করে লাভ নেই। ডলারের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বাজারমূল্যে বড় তারতম্যের সৃষ্টি হয়েছে। এটি সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে।

সাধারণত স্বর্ণ ও সাতটি বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভের অর্থ জমা রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে স্বর্ণ জমা রাখা আছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে। মার্কিন ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার ও চায়নিজ ইউয়ানে সংরক্ষণ করা হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। দেশের রিজার্ভের প্রায় ৮০ শতাংশই রাখা হয় নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে (এফআরবি)। সিংহভাগ রিজার্ভ এফআরবিতে রাখা হয়েছে মূলত নিউইয়র্কের রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বন্ডে বিনিয়োগ, আমদানি বিল পরিশোধ ও দাতা সংস্থার ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য। সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনের (সুইফট) মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় এসব পেমেন্ট দেয়া হয়।