কাঙ্ক্ষিত ব্যবসা না হওয়ায় ব্যথানাশক ওষুধ ডিসপ্রিন ও মশা নিধনকারী মরটিন কয়েল উৎপাদন বন্ধ করেছে রেকিট বেনকিজার (বিডি) লিমিটেড। অন্যদিকে কোম্পানিটি নিজেদের কারখানায় ডেটল সাবান উৎপাদন শুরু করেছে। আইন অনুযায়ী, কোম্পানির পক্ষ থেকে মূল্যসংবেদনশীল এসব তথ্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা। কিন্তু রেকিট বেনকিজার তা জানায়নি।
কোম্পানি সূত্র অনুযায়ী, রেকিট বেনকিজার মূলত টয়লেট্রিজ ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদন করে। কোম্পানিটি চট্টগ্রামে নিজস্ব কারখানায় ডিসপ্রিন ও মরটিন কয়েল উৎপাদন করত। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যবসা না হওয়ায় গেল বছরের মাঝামাঝিতে ডিসপ্রিন ও ২০১৬ সালে মরটিন কয়েল উৎপাদন বন্ধ করা হয়।
এদিকে কোম্পানিটি টোল ম্যানুফ্যাকচারিং এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে হক গ্রুপের কারখানায় ডেটল সাবান উৎপাদন করত। পরবর্তী সময়ে ডেটল সাবান নিজেদের কারখানায় উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয় রেকিট বেনকিজার পর্ষদ। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালে কোম্পানিটির চট্টগ্রাম কারখানায় নতুন প্লান্ট স্থাপন করা হয়। গত বছরের জানুয়ারিতে এ প্লান্টে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। এর প্রায় তিন মাস পর বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় প্লান্টটি।
কোম্পানিটি নিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদনে খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বটে, কিন্তু আইন অনুযায়ী স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে এ তথ্য প্রকাশ করেনি।
মূল্যসংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লিস্টিং রেগুলেশনের ৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ) বিধিমালা, ১৯৯৫-এর মূল্যসংবেদনশীল সংজ্ঞামতে মূল্যসংবেদনশীল হতে পারে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত তালিকাভুক্ত কোম্পানির পর্ষদে নেয়া হলে সে তথ্য সভা শেষ হওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে লিখিতভাবে স্টক এক্সচেঞ্জ ও কমিশনকে জানাতে হবে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ) বিধিমালা, ১৯৯৫-তে মূল্যসংবেদনশীল তথ্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মূল্যসংবেদনশীল হলো এমন তথ্য, যা প্রকাশ হলে সংশ্লিষ্ট সিকিউরিটির বাজারমূল্য প্রভাবিত হতে পারে। এমন তথ্য বলতে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কিত প্রতিবেদন বা এ-সংক্রান্ত মৌলিক তথ্য, লভ্যাংশসংক্রান্ত তথ্য, রাইট শেয়ার বা বোনাস ইস্যু, স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত, কোম্পানির বিএমআরই বা নতুন ইউনিট স্থাপন, কোম্পানির কার্যাবলির ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন (যেমন—উৎপাদিত সামগ্রী, পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন বা এ-সম্পর্কিত নীতিনির্ধারণ প্রভৃতি) এবং কমিশন কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো তথ্যকে বোঝানো হয়েছে।
এ বিষয়ে রেকিট বেনকিজারের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ নাজমুল আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, ডিসপ্রিন ও মরটিনে আমাদের লোকসান হচ্ছিল। এর প্রভাবে শেয়ারহোল্ডারদের যেন কোনো লোকসান না হয়, তার জন্য আমরা এ দুটি পণ্যের ব্যবসা বন্ধ করেছি।
তিনি আরো বলেন, আগে অন্যের কারখানায় ডেটল সাবান প্রস্তুত করা হতো। কিন্তু মান নিয়ন্ত্রণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ডেটল সাবান উৎপাদনের জন্য নিজেদের কারখানায় নতুন প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এ প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এতে আমাদের ব্যবসায় কোনো প্রভাব পড়েনি। আগে ডেটল সাবান উৎপাদনে যা খরচ হতো, এখনো তা-ই হচ্ছে।
মূল্যসংবেদনশীল তথ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মূল্যসংবেদনশীল তথ্য বলতে বোঝায় এমন সিদ্ধান্ত, যার জন্য কোম্পানির ব্যবসায় বড় ধরনের পরিবর্তন হয়। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্তের কারণে কোম্পানির ব্যবসায় বড় ধরনের পরিবর্তন হয়নি। তাই আমরা মূল্যসংবেদনশীল তথ্য হিসেবে এ তথ্য প্রকাশের প্রয়োজন মনে করিনি।
ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, সিকিউরিটিজ আইনে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে কোনটা মূল্যসংবেদনশীল তথ্য। কোম্পানিগুলোকে এ আইন মেনে চলতে হবে।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলে সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ডিএসইতে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ২ হাজার ৩৯৯ টাকা। সেখান থেকে ২১ মার্চ দর ১ হাজার ১৯৭ টাকা বা ৫০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৯৬ টাকা।
এর আগে ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১ হাজার ৭২২ টাকা। ২৭ নভেম্বর দর ৪১ দশমিক ৪৬ শতাংশ বা ৭১৪ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৩৬ টাকা। এছাড়া ২০১৭ সালের ৬ থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ারদর ১ হাজার ৫৯৭ টাকা থেকে ৬৩১ টাকা বা ৪০ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ২২৯ টাকা হয়েছিল। এর মধ্যে ডিএসই থেকে দর বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে নোটিস দিলে কোম্পানিটি কোনো মূল্যসংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানায়।
গতকাল ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ২ হাজার ১১০ টাকায় লেনদেন হয়। সমাপনী দর ছিল ২ হাজার ৯৩ টাকা।
৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব বছরের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ৭০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদানের সুপারিশ করেছে রেকিট বেনকিজারের পরিচালনা পর্ষদ। ৩০ মে বেলা ১১টায় চিটাগং বোট ক্লাব কনভেনশন সেন্টারে কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হবে। এর জন্য রেকর্ড ডেট ছিল ৮ মে। গেল হিসাব বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৭০ টাকা ২২ পয়সা। ৩১ ডিসেম্বর শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৮১ টাকা ৬৩ পয়সা। ২০১৭ হিসাব বছরে ইপিএস ছিল ৮০ টাকা ৬৩ পয়সা ও এনএভিপিএস ৬৪ টাকা ২৮ পয়সা।
এদিকে চলতি ২০১৯ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ১৫ টাকা ৪৬ পয়সা। ৩১ মার্চ এনএভিপিএস দাঁড়িয়েছে ৯৭ টাকা ৯ পয়সা। গত হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস ছিল ৭ টাকা ৩৪ পয়সা।
১৯৮৭ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ২৫ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ৪ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মোট শেয়ার সংখ্যা ৪৭ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে ৮২ দশমিক ৯৬ শতাংশ বা ৩৯ লাখ ১৯ হাজার ৯১৮টি শেয়ারই রয়েছে মূল কোম্পানি যুক্তরাজ্যভিত্তিক রেকিট বেনকিজার পিএলসির কাছে। এছাড়া সরকারের কাছে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪ দশমিক শূন্য ৮, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে ২ দশমিক ৯৮ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বাকি ৬ দশমিক ২১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।