Decision Maker

মন্ত্রীরা বিএনপিকে সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে খুঁজে বের করতে সদা সচেষ্ট।

দেশের মানুষ কোথাও প্রকাশ্যে বিএনপির তৎপরতা না দেখলেও সরকারের মন্ত্রীরা বিএনপিকে সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে খুঁজে বের করতে সদা সচেষ্ট। কোনো অঘটন ঘটলেই তার পেছনে বিএনপির ষড়যন্ত্র আবিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। কৃষক ধানের দাম পাননি, মন্ত্রীরা বললেন, এর পেছনে বিএনপির কারসাজি আছে। গণপিটুনিতে মানুষ মারা গেছে, মন্ত্রীরা—আওয়ামী লীগের বাঘা নেতারা বললেন, এর ভেতরে বিএনপি-জামায়াত আছে।

প্রথমে ঢাকা শহরে এবং পরে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে, তার ভেতরেও কেউ কেউ বিএনপির ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন।

সরকারের মন্ত্রীদের দায়িত্ব কি শুধু বক্তৃতা দেওয়া? যে–ই ষড়যন্ত্র করুক না কেন, সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে শত শত গায়েবি মামলা আছে। কিন্তু ধানের দাম কমা কিংবা ডেঙ্গু রোগের বিস্তার নিয়ে বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। মন্ত্রীরা, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা অনর্গল বলে যাচ্ছেন, বিএনপি এটা করেছে, ওটা করেছে। তাঁরা নিজেরা কী করছেন, সে কথা একবারও বলছেন না। মন্ত্রী-মেয়ররা বলেন, জনগণকে সজাগ হতে হবে। কিন্তু ঈদের আগে সড়ক ও ট্রেন ব্যবস্থাপনা নিয়ে এত কথা হলো, তাঁদের হুঁশ ফিরল না। আর সবকিছুর পেছনে যদি বিএনপি থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ করছেটা কী? তাদের কাজ কি শুধু সমস্যা জিইয়ে রেখে বিএনপির ওপর দোষ চাপানো।

এই যে আগুন লেগে মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তি পুড়ে হাজার হাজার মানুষ সর্বস্বান্ত হলো, তার পেছনেও কি বিএনপি আছে? বস্তির বাসিন্দারা বলেছেন, বস্তি নিয়ন্ত্রণকারীরা রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজি রজ্জব হোসেনের লোক। এই অবৈধ ব্যবসা থেকে তাঁদের মাসে আয় ছিল ৩০ লাখ টাকার বেশি। রজ্জব হোসেনও অস্বীকার করেননি যে বস্তি থেকে টাকা তোলায় নিয়োজিত লোকেরা আওয়ামী লীগের নন। বলেছেন, ‘তারা আমার লোক নয়, তারা নব্য আওয়ামী লীগার।’ হাইব্রিড আওয়ামী লীগার হোন আর জং ধরা আওয়ামী লীগার হোন, বস্তিবাসীদের থেকে তাঁরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা বলেন, বস্তির ভেতরে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে গ্যাসের সংযোগ ছিল। সেই সংযোগ দিয়ে প্রতিটি ঘরেই রান্না হতো। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বস্তির দক্ষিণ দিকের একটি ঘর থেকে প্রথমে আগুন লাগে। আগুনে গ্যাসের পাইপ ফেটে যায়। এতে আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাসের কারণে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায়। অনেক দূর থেকে সে আগুন দেখা যাচ্ছিল। বেশির ভাগ বাসিন্দা ঈদের কারণে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন।

বাংলাদেশে এমন কোনো বস্তি নেই, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন দখলবাজি ও চাঁদাবাজি করছেন না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে বিএনপির লোকজন বস্তি দখল করেন। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের লোকজন। বস্তি ক্ষমতাসীনদের একটি বড় ব্যবসা। ২০০০ সালে যখন ঝিলপাড়ে বস্তি গড়ে ওঠে, তখন এটি বিএনপি ও যুবদলের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ঘর তুলে ভাড়া দিতে শুরু করেন। তাঁরা বস্তিতে পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দিয়ে প্রতিটি ঘর থেকে দুই হাজার টাকা এবং ভাড়া বাবদ প্রতিটি ঘর থেকে দুই হাজার টাকা করে আদায় করেন।

তবে কোরবানির চামড়া সংকট নিয়ে নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি বলেছেন, কোরবানির ঈদে জবাই করা পশুর চামড়ার দাম না পাওয়ার পেছনে বিএনপির কারসাজি ছিল। কীভাবে? তাঁর স্পষ্ট ভাষণ: বিএনপির লোকজন চামড়া কিনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। মাননীয় মন্ত্রী বিএনপির এই ষড়যন্ত্র যখন বুঝতে পারলেন, তখন কেন তিনি আওয়ামী লীগের লোকজন লাগিয়ে চামড়া কেনার ব্যবস্থা করলেন না। বিএনপির লোকজন চামড়া কিনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন চামড়া কিনলে হয়তো রাস্তায় না ফেলে সেই চামড়া নিজেরাই পাকা করে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী জুতা-ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি করে দিতেন। তাহলে দেশে আর চামড়ার কোনো সমস্যাই থাকত না।

তবে মন্ত্রী মহোদয় হয়তো জানেন না, অথবা জানলেও স্বীকার করবেন না যে এবার চামড়ার দামে ধস নামায় যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্মীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেননা, প্রতি কোরবানির ঈদে তাঁদের অনেকে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে দুই পয়সা লাভ করেন। এবারে লাভ দূরের কথা, পুঁজিটুকুও শেষ।

মন্ত্রী একদিকে বলছেন, চামড়া সংকটের জন্য বিএনপি দায়ী, অন্যদিকে বলছেন, চামড়া সংকট কেটে গেছে। তার এই বক্তব্য কেবল স্ববিরোধী নয়, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টাও বটে। সারা দেশের মানুষ দেখল, চামড়া নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটছে। মন্ত্রী বললেন, ও কিছু না। মাত্র এক কোটির মধ্যে মাত্র ১০ হাজার চামড়া অবিক্রীত থেকেছে। মন্ত্রীর এই তথ্য মনগড়া। চট্টগ্রামেই এক লাখ চামড়া ফেলে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অর্ধেক চামড়া অবিক্রীত থেকে গেছে। আর এক হাজার টাকার চামড়া যদি ১০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে, সেটি বিক্রি বলা যায় না। অনেকে গাড়িভাড়ার ভয়ে চামড়া ফেলে দিয়েছেন।

মন্ত্রী এসব বলে কাদের চোখে ধুলা দিতে চাইছেন? পত্রিকায় দেখলাম, চামড়া সংকট নিয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এফবিসিসিআইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সমস্যা সমাধানের। চামড়ার আড়তদার ও ট্যানারি মালিকেরা বলেছেন, এফবিসিসিআই যে সিদ্ধান্ত দেবে, তাই তাঁরা মেনে নেবেন। এর আগে আড়তদারেরা বলেছিলেন, গত বছরের বকেয়া টাকা মালিকেরা না দেওয়ায় তাঁরা এবার চামড়া কিনতে পারেননি। মালিকেরা বলেছেন, সাভারে চামড়াশিল্পের অবকাঠামো পুরোপুরি ঠিক না হওয়ায় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ কারণে আড়তদারদের বকেয়া শোধ করতে পারেননি। এ অবস্থায় কাঁচা চামড়া রপ্তানি করলে চামড়াশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। শিল্পমন্ত্রী হিসেবে নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন সাহেব সাভার চামড়াশিল্পের অবকাঠামো উন্নয়নে কী করেছেন। তাঁর দুই পূর্বসূরি কী করেছেন, সেটি জানার অধিকার দেশবাসীর আছে।

আগে এ ধরনের সংকট হলে মন্ত্রীরাই দায়িত্ব নিতেন। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতেন। এখন সেই মন্ত্রীর কাজটি যদি এফবিসিসিআই করে, তাহলে মন্ত্রীদের কাজ কি শুধু বক্তৃতা দেওয়া? শুধুই বিএনপির ষড়যন্ত্র খোঁজা। কিন্তু মাননীয়দের এটা মনে রাখতে হবে যে কিছু লোককে কিছুদিনের জন্য বোকা বানানো গেলেও দেশের সব মানুষকে বোকা বানানো যায় না।

 © সোহরাব হাসান

Exit mobile version