দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মূল ক্ষেত্র পুঁজিবাজার। এখান থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হয়ে সব খাতে যাবে। এটি বিশ্বের সব পুঁজিবাজারে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের সব পুঁজি সংগ্রহের মূল উৎস হয়ে গেছে ব্যাংক খাত, যে কারণে ব্যাংক খাতে ঋণ খেলাপির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে বিরাজ করে টানা নাজুক পরিস্থিতি। যা বিনিয়োগকারীদের হতাশায় ফেলে দেয়। দীর্ঘদিন খারাপ অবস্থানে থাকার কারণে অনেক বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাজার ছেড়েছেন। এত নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকা সত্ত্বেও পুঁজিবাজারের এমন নাজুক অবস্থা। আসলে পুঁজিবাজার যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, বিএসইসির চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজারের আরও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা করে বলেছেন, গত ১০ বছরে দেশের অর্থনীতি অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছে। পুঁজিবাজার সেই গতিতে এগোবে না, এটা হতে পারে না। দেশের অর্থনীতি যতটা গতিশীল, পুঁজিবাজারকেও ততটা গতিশীল দেখতে চাই। এটাই ছিল এ সভার মূল প্রতিপাদ্য। বাজার টেকসই করার জন্য প্রাইমারি মার্কেটকে আরও গতিশীল করতে হবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষাসহ ভালো মানের পণ্য বাজারে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। আবার আইপিওতে যাতে শেয়ারের সঠিক মূল্য নির্ধারিত হয়, এ বিষয়ে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ আইপিওতে শেয়ার অতিমূল্যায়িত হলে পরে সে দাম থাকে না। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়েন। এখন একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে চাই, যাতে বিনিয়োগকারী নির্ভয়ে বাজারে আসতে পারেন। একইভাবে সেকেন্ডারি মার্কেটকেও গতিশীল করা হবে।’ যদিও এসব কথা অর্থমন্ত্রী অনেকবারই বলছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানতের অনুপাত (এডিআর) বাড়ানোর পর গ্রামীণফোনের সমস্যা সমাধানে অর্থমন্ত্রী ইঙ্গিত দিলেও তার ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না পুঁজিবাজারে। বরং উল্টাপাল্টা আচরণ করছে এটি। যেখানে বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখার কথা, সেখানে উল্টো টানা বড় দরপতন হচ্ছে। এটা কিছুতেই স্বাভাবিক আচরণ নয়। কাজেই বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বাজারে টাকার ফ্লো বাড়লে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বাড়বে। তখন সমস্যাও কেটে যাবে বলে মনে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, বাজারে বিভিন্নভাবে কারসাজি হচ্ছে। সেটিই বাজার পতনের বড় কারণ। বেশি কারসাজি হয় যখন নতুন কোনো কোম্পানি বাজারে আসে। তখন ওই কোম্পানি তাদের আর্থিক প্রতিবেদন আকর্ষণীয়ভাবে প্রকাশ করার পর বাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু কিছুদিন পরে ওইসব কোম্পানি বাজারে খুঁজে পাওয়া যায় না। পরে এসব কোম্পানি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন ওঠে। আবার বাজারে কোম্পানি আনার ক্ষেত্রে ইস্যু ম্যানেজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কোনো শাস্তি দিতে দেখা যায়নি। বিনিয়োগকারীরা তাদের কষ্টে অর্জিত সঞ্চয় বাজারে বিনিয়োগ করে। কিন্তু বাজার যদি প্রতিনিয়ত এভাবে পড়তে থাকে এবং কারসাজি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীর টাকা নিতে থাকে, তাহলে কীভাবে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পাবে এবং কি করে দৈনিক তিন হাজার কোটি টাকা লেনদেন হবে। আমরা বলি অর্থনীতি অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুঁজিবাজারের লেনদেন তিন হাজার কোটি টাকা হওয়া উচিত। অনেক অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক বলেন, পুঁজিবাজারকে স্বাভাবিক করতে হলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে কেন্ত্রীয় ব্যাংক, বিএসইসি, ডিএসই, সিএসইসহ আরও যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেখানে নতুন নেতৃত্ব আনতে হবে। যারা উদ্যোগী, যোগ্য ও সৎ তাদেরকে আনতে হবে। ধার করা জ্ঞানে এ বাজারকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয় বলেও মনে করছেন ওই বিশ্লেষকরা।

এদিকে, সাপ্তাহিক বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অর্থমন্ত্রীর সভা করার আগের দিন ও পরের দিন বাজার কিছুটা উত্থানে ছিল। তবে পরের তিন কার্যদিবস পতনে হয়েছে। ফলে সপ্তাহশেষে উত্থানের চেয়ে পতনের মাত্রাই বেশি। এরই অংশহিসেবে দেশের উভয় পুঁজিবাজারের সব সূচক কমেছে। তবে টাকার পরিমাণে লেনদেন বেড়েছে। বিদায়ী সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭৮ পয়েন্ট বা ১.৫৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৫৬ পয়েন্টে। অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ৩৩ পয়েন্ট বা ২.৯০ শতাংশ এবং ডিএসই-৩০ সূচক ১ পয়েন্ট বা ০.০৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১১২৩ পয়েন্ট এবং ১৭৩৬ পয়েন্টে। ডিএসইতে বিদায়ী সপ্তাহে ৩৫৫টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ৮৩টির বা ২৪ শতাংশের, কমেছে ২৩৯টির বা ৬৭ শতাংশের এবং ৩৩টির বা ৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর অপরিবর্তিত রয়েছে। এগুলোর ওপর ভর করে ডিএসইতে ১ হাজার ৮৯৭ কোটি ৯৫ লাখ ২১ হাজার ৭৩৩ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের সপ্তাহ থেকে ২১১ কোটি ৭৭ লাখ ১৯ হাজার ৩৩৭ টাকা বা ১২.৬৪ শতাংশ বেশি। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৮ লাখ ০২ হাজার ৩৯৬ টাকার।

অন্যদিকে, সাপ্তাহিক ব্যবধানে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২২২ পয়েন্ট বা ১.৪৭ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৬০ পয়েন্টে। এছাড়া সিএসসিএক্স ১৩৫ পয়েন্ট বা ১.৪৮ শতাংশ, সিএসই-৩০ সূচক ৩৭৫ পয়েন্ট বা ২.৮৪ শতাংশ, সিএসই-৫০ সূচক ৯ পয়েন্ট বা ০.৭৭ শতাংশ এবং সিএসআই ২৫ বা ২.৪৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮ হাজার ৯৬০, ১২ হাজার ৭৮৬, ১ হাজার ৮৩ ও ৯৬৬ পয়েন্টে। আর বিদায়ী সপ্তাহে সিএসইতে মোট ৩০৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের হাত বদল হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৭৯টির, দর কমেছে ২০৩টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ২৪টির। এগুলোর ওপর ভর করে সপ্তাহজুড়ে ১৫৮ কোটি ৫৬ লাখ ৯৫ হাজার ২৮০ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ১১০ কোটি ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৮৬ টাকার। এ হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে সিএসইতে টাকার পরিমাণে লেনদেন ৪৮ কোটি ৪৫ লাখ ৩৭ হাজার ৬৯৪ টাকা বা ৪৪ শতাশ বেড়েছে।