কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে মূলধন বাজারে যে ভূমিকা, বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেট এখনো সেই ভূমিকায় ঐভাবে আসতে পারেনি। এর পেছনের বিভিন্ন কারনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্বার্থান্বেষী, চতুর মহলের চাতুর্য্যপূর্ন বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত অর্থাৎ পরিকল্পনা মাফিক কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক শেয়ারে বিনিয়োগের মাধ্যমে সাধারন বিনিয়োগকাকারীদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা। সাধারণত এক্ষেত্রে জুয়াাড়িদের প্রথম পছন্দ হয়ে থাকে স্বল্প পরিশোধিত মূলধন বিশিষ্ট কোম্পানির শেয়ার। আর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আগ-পিছ না ভেবে তাদেরকে অনুসরণ করতে থাকেন ফলে যা হবার তাই হয়। যা পুঁজিবাজারে দীর্ঘসময়ব্যাপী প্রত্যক্ষ করে আসছে।

বেশকিছু কোম্পানীর ক্ষেত্রে আইপিওতে আসার পর কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা অথবা ব্যবসায়িক ঝুঁকি মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত কার্যকর পদক্ষেপের অভাবও পরিলক্ষিত হয়েছে, আর এই সুযোগকে শেয়ারবাজারের বিদ্যমান জুয়াড়ীরা (Gamblers) কাজে লাগান। যার কুফল শেষ মেষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে এসে পড়ে।

বিশ্লেষকদের মতে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মূল দর্শন থেকে সরে এসে সাধারন বিনিয়োগকারীদের স্বল্প সময়ে অতি মুনাফার আশাও শেয়ারবাজারের আজকের এই অবস্থানে আসার জন্য অনেকটাই দায়ী ।  এ অবস্থা থেকে উত্তরণ তখনই সম্ভব যখন পুঁজিবাজারকে অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা যাবে। বাজারের উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা এমনি এমনি আসবে না। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বল্প সময়ে বেশী মুনাফার প্রত্যাশা পরিত্যাগ করা, দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের মানসিকতা গড়ে তোলা, কোন প্রকার গুজবে কান না দিয়ে সঠিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নৈতিক উন্নতি সাধন ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন, আইপিওতে আসতে যাচ্ছে এমন কোম্পানিগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ, মৌলভিত্তি সম্পন্ন বৃহৎ কোম্পানিকে বাজারে আনতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন ও সহায়তা প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও গতিশীল পুঁজিবাজার পরিণত করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।

জানা যায়, বিএসইসি, ডিএসই, সিএসইসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ বৃহৎ, বহুজাতিক ও মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দীর্ঘ সময় ব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে। যার সমর্থনে বর্তমান সরকারের সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে এবং যা বিনিয়োগকারীদেরও দীর্ঘ দিনের দাবী। সম্প্রতি বাজারে আসা কিছু কোম্পানির তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনা করে পরিলক্ষিত হয় যে, বেশিরভাগ কোম্পানির Pre IPO Capital ৪০ থেকে ৬০ কোটি টাকার মধ্যে এবং তাদের বেশিরভাগই ১৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা IPO এর মাধ্যমে উত্তোলন করেছে। আইপিও পরবর্তী Capital দাঁড়াচ্ছে ৫৫ থেকে ৯০ কোটি টাকার মধ্যে। অথচ তাদের annual turnover ৪০ থেকে ১০০ শত কোটি টাকার মধ্যে অর্থাৎ Paidup Capital কোম্পানিটির annual turnover এর সমান বা বেশী।

অতি সম্প্রতি Ring Shine Textiles Ltd. নামে টেক্সটাইল খাতের একটি কোম্পানিও আইপিও অনুমোদন পায় এবং কোম্পানিটি ষ্টক এক্সচেঞ্জে ট্রেডিং এর জন্য অপেক্ষমাণ। উক্ত কোম্পানিটির প্রসপেক্টাস ও ফিনান্সিয়ালস থেকে জানা যায়, কোম্পানিটি আইপিও পূর্ববর্তী পরিশোধিত মূলধন ছিল ২৮৫ কোটি ৫ লক্ষ ৪৮ হাজার ২০০ টাকা যা আইপিও পরবর্তী ৪৩৫ কোটি ৫ লক্ষ ৪৮ হাজার ২০০ টাকায় উপনীত হয়।

কোম্পানিটি আইপিও এর মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা fixed price method এর মাধ্যমে উত্তোলন করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ৩য় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটির প্রফিটিবিলিটি (ইপিএস) গত বছরের সংশ্লিষ্ট প্রান্তিকের টাকা ০.৫০ হতে বৃদ্ধি পেয়ে টাকা ০.৭০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। NAV দাঁড়িয়েছে ২৫.৫৩ টাকায় যা গত বছরে ছিল ২৪.৮৮ টাকায়। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছর শেষে Net Operating Cash Flow per share ( NOCFPS) বৃদ্ধি পেয়ে ১.৮৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে যা পূর্বের অর্থ বছরে ছিল ০.০৫ টাকা।

কিন্তু কোম্পানিটির স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের ব্যাপারে বেশ বিতর্ক জন্ম দিয়েছে। যে কারণে তালিকাভুক্তির অনুমোদন পাওয়ার পরও রিংসাইনের শেয়ার লেনদেন হতে বিলম্ব হচ্ছে।

এ ব্যাপারে কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানি সচিব আশরাফ আলী শেয়ারবাজারনিউজ ডটকমকে জানান, রিংসাইন একটি প্রথম সারির, বৃহৎ, হাজার কোটি টাকার বেশি turn over সমৃদ্ধ কোম্পানী যার turn over পরিশোধিত মূলধনের দ্বিগুনেরও বেশি। এমন কোম্পানিটির বিরুদ্ধাচারণ করতে বাজার সংশ্লিষ্ট স্বার্থান্বেষীমহল অপতৎপরতা চালাচ্ছে। কিছু সুবিধাবাদী, অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড জুয়াড়িরা আওয়ামীলীগের নাম ব্যবহার করে শেয়ারবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। যা বর্তমান সরকার ও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভাবমূর্তি সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে ।

বর্তমানে Ring Shine কোম্পানিটির annual turnover প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। কোম্পানিটি বাজার থেকে সংগৃহীত অর্থের মাধ্যমে ডেনিম প্রজেক্ট করবে, যার ফলশ্রুতিতে কোম্পানির projected annual turnover প্রায় ১ হাজার ৪ শত কোটি থেকে ১ হাজার ৫ শত কোটি টাকায় উন্নীত হবে, যা প্রসপেক্টাস এর Projection’ এ বলা হয়েছে।  কোম্পানির Post IPO Capital ৪৩৫ কোটি টাকা (আইপিও থেকে সংগৃহীত ১৫০ কোটি টাকাসহ)। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কোম্পানিটির Paidup Capital তার projected annual turnover এর প্রায় তিনভাগের এক ভাগ ।

সুতরাং কোম্পানিটিকে আমাদের শেয়ারবাজারের জন্য বিবেচ্য মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অথচ কোন রকম তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই হীন স্বার্থ চরিতার্থে বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্য মূলকভাবে অমূলক তথ্য ছড়িয়ে এবং উপস্থাপিত তথ্যের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে উক্ত কোম্পানির শেয়ার ট্রেডিংকে অযাচিত বিলম্বিত করার খেলায় মেতে উঠেছে কেউ কেউ।

যার পরিণতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভোগান্তিতের সদ যোগাচ্ছে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, জুয়াড়িদের প্রথম পছন্দ স্বল্প মূলধনী কোম্পানী, যারা আইপিও এর মাধ্যমে স্বল্প শেয়ারবাজারে ছেড়েছে, যার আইপিও পরবর্তী প্রথম তিন বছর(লক-ইন সময়) বিক্রয়যোগ্য শেয়ার কম থাকে এবং এই সময়ে তারা উক্ত শেয়ারের দরবৃদ্ধি করে নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বাজার থেকে সরে পড়ে।

Ring Shine কোম্পানিটি শুরুতেই ১৫০ কোটি টাকার বৃহৎ পরিমানের শেয়ার বাজারে ছাড়ছে, যাতে ঐ সমস্ত জুয়াড়িরা ইচ্ছা করলেই কারসাজি করতে পারবে না। কারণ এক্ষেত্রে তাদের বৃহৎ অংকের পুঁজির সমন্বয় করতে হবে, যা তাদের জন্য অনেকটাই কঠিন হবে। আর এ কারনেই ঐ সমস্ত জুয়াড়িরা কোম্পানির শেয়ার ট্রেডিংকে অযাচিত বিলম্বিত করার খেলায় মেতে উঠেছে বলে তিনি জানান।

কোম্পানি সচিব আরো বলেন, কোম্পানিটিতে ৩ জন Independent Director সহ সর্বমোট ১২ জন Director রয়েছে যার মধ্যে Independent Director ছাড়া বাকি ৯ জনই বিদেশি। উক্ত ৯ জন বিদেশি Director কর্তৃক Ring Shine প্রায় ২২ বছর যাবত বাংলাদেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালিত হয়ে আসছে। কোম্পানিটি Dhaka EPZ এর প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা নিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

যে কেউ সরেজমিনে রিংসাইনের ফ্যাক্টরী পরিদর্শন করলেই সহজেই কোম্পানির ভিত্তি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে পারবে। কোম্পানিটিকে নিয়ে জুয়াড়ীদের বিরুপ আচরণের কারনে Director রা খুবই হতাশ ও বিরক্ত। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ভালভাল কোম্পানি তথা বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অন্তর্ভুক্ত হতে অনীহা প্রকাশ করবে যা বাজারের জন্য মোটেও সুখকর হবে না বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, বিগত তিন বছরে শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিভিন্ন কোম্পানির উপর তুলনামুলক চিত্র যাচাই করে দেখা যায় Ring Shine এ সময়ে শেয়ারবাজারে আসা একটি অন্যতম ভাল কোম্পানি, যাতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকবে বলে আশা করা যায়। বাজার সংশ্লিষ্টরা Ring Shine এর সাথে গত তিন বছরে বাজারে আসা অন্য কোম্পানিগুলো পরিদর্শনের বা খোঁজখবর নেওয়ার এবং তুলনামুলক যাচাই করলেই প্রকৃত তথ্য জানতে পারবেন। যে সকল সুবিধাবাদী, অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড জুয়াড়িরা আওয়ামীলীগের নাম ব্যবহার করে শেয়ারবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে, একটি শক্তিশালী প্রাণবন্ত পুঁজিবাজারের স্বার্থে এসব স্বার্থলোলুপ নামধারী আওয়ামী (হাইব্রিড) জুয়াড়িদের অশুভ ছায়া পুঁজিবাজার থেকে সরাতে এবং পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অংশ হিসেবে সর্বোপরি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে উক্ত অসাধু ব্যাক্তিদের চিহ্নিত করে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক। পুঁজিবাজারের এই অশুভ শক্তিকে পরিষ্কার করতে না পারলে মৌলভিত্তি সম্পন্ন বৃহৎ ও বহুজাতিক কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনা কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।