ঈদের আগে-পরে মিলে তিন সপ্তাহে শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণে পুঁজিবাজারের প্রধান মূল্যসূচক যতটা এগিয়েছিল, গত এক সপ্তাহেই এর থেকেও বেশি পিছিয়েছে। গত ২৮ জুলাই থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত তিন সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১০৩ পয়েন্ট বেড়েছিল। গতকাল বৃহস্পতিবারের ৪৪ পয়েন্টসহ এ সপ্তাহে তা কমেছে ১৪২ পয়েন্ট।

শুধু গতকাল নয়, চলতি সপ্তাহের পুরোটা সময়ে দরপতন হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি সপ্তাহে ৮৫ শতাংশ শেয়ার দর হারিয়েছে, যেখানে দর বেড়েছে মাত্র ১৩ শতাংশের। এ সময়ে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত দরপতন হয়েছে ১৫১ শেয়ারের। এর মধ্যে গতকাল ডিএসইতে ৬৭ শতাংশ শেয়ারের দরপতন হয়েছে। দ্বিতীয় পুঁজিবাজার সিএসইতে দর হারিয়েছে লেনদেন হওয়া ৭৭ শতাংশ শেয়ার। এতে উভয় বাজারের প্রধান দুই সূচক কমেছে প্রায় ১ শতাংশ হারে।

চলতি সপ্তাহের বড় দরপতনে সব কোম্পানির সমুদয় শেয়ারের বাজারদর (বাজার মূলধন) কমেছে সাত হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। অথচ এর আগের টানা তিন সপ্তাহের দরবৃদ্ধিতে বাজার মূলধন বেড়েছিল তিন হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন সপ্তাহে শেয়ারদর যতটা বেড়েছিল, এক সপ্তাহে এর প্রায় দ্বিগুণ কমেছে।

এমন দরপতনের কারণ জানতে চাইলে বাজার-সংশ্নিষ্টরা জানান, এখন কেউ নতুন করে বিনিয়োগে আসছে না। বিনিয়োগ করে মুনাফা করা যাবে- এমন বিশ্বাস বা আস্থা না থাকাই এর প্রধান কারণ। পুঁজিবাজার বিশ্নেষক ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় অনুষদ বিভাগের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ মূসা বলেন, পুরো পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে পুরনো বিনিয়োগকারীরা লেনদেনে নিষ্ফ্ক্রিয়। টানা লোকসানে বিরক্ত হয়ে তাদের অনেকে শেয়ার বিক্রিও করে থাকতে পারেন। এতে শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়েছে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি পুরো বাজার পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে। গ্রামীণফোনের কাছে বড় অঙ্কের করদাবির ইস্যুটিও বাজারে বড় সংকট তৈরি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আর্থিক খাতের দীর্ঘদিনের সংকটও পুঁজিবাজারকে ভোগাচ্ছে। সার্বিকভাবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আস্থাহীনতার কারণ জানতে চাইলে রাজধানীর বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে সুশাসনের অভাবকে দায়ী করেন। তারা বলেন, বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার সুযোগে কারসাজিকারকরা নানাভাবে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। আইপিওতেও অনিয়ম থেমে নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। এরই মধ্যে বেশ কিছু শেয়ার নিয়ে কারসাজি চলছে, যেগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও প্রতিকার নেই।

লংকাবাংলা ব্রোকারেজ হাউসের একজন বিনিয়োগকারী আহমেদ সবুর বলেন, গত কয়েক বছরে পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা করেছেন এমন ভাগ্যবান বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এর মধ্যেও কিছু শেয়ারের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কারসাজির বিষয়টি সুস্পষ্ট হলেও এগুলো নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। অথচ এগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা বহাল তবিয়তেই আছেন।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, বৃহৎ মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতনে সূচকে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, গ্রামীণফোনের কাছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির প্রায় ১৩ হাজার টাকার কর দাবি এবং অনাদায়ে লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ের খবরের বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। এর বাইরে অন্য কোনো কারণ জানা নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।

গতকাল ডিএসইর লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোনো খাতই দরপতনের বাইরে ছিল না। সার্বিকভাবে ১ শতাংশের ওপর দর হারিয়েছে ব্যাংক, বস্ত্র, খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক এবং সিমেন্ট খাত। সর্বাধিক সোয়া ২ শতাংশ দরপতন হয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতে। সূচক পতনে বড় ভূমিকা ছিল ব্র্যাক ব্যাংক, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, বিএটিবিসি, গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা, রেনেটাসহ পুরো ব্যাংক খাতের। এগুলোর কারণে সূচক কমেছে প্রায় ২৮ পয়েন্ট।