বাজেট পাশ হওয়ার আগে বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে উঠছেন। এতে ক্রমেই ইতিবাচক হচ্ছে পুঁজিবাজার। ফলশ্রুতিতে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তিন কার্যদিবসেই দেশের পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সপ্তাহজুড়ে উভয় পুঁজিবাজারের সব সূচক বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে বাজার মূলধনও। তবে কমেছে সপ্তাহজুড়ে লেনদেন করা বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। আর এক বাজারে সার্বিক লেনদেন কমলেও অন্যটিতে বেড়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামীকাল মহান জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পাস হবে। এর আগে আজ পুঁজিবাজারের রিটেইনড আর্নিংস ও রিজার্ভের ওপর কর প্রত্যাহার করে অর্থবিল- ২০১৯ পাস হতে পারে। এটা বিনিয়োগকারীদের জোর দাবি ছিল। কাজেই কর প্রত্যাহার করা হলে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে পুরোপুরি সক্রিয় হবেন। যা বাজারের হারানো গতি ফিরিয়ে দেবে। তাছাড়া এ বাজেটকে আরও বেশি পুঁজিবাজারবান্ধব করতে অর্থমন্ত্রীর প্রতি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিশেষ করে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বন্ডে বিনিয়োগের সুবিধা চাওয়া হয়েছে। কেননা শিল্প-অর্থায়নে ব্যাংক নির্ভরতা কমাতে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করা দরকার। এজন্য দরকার একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে তোলা। বন্ড মার্কেট বিকাশের সুবিধার্থে বন্ডে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলে পুঁজিবাজারকে আর পিছনে তাকাতে হবে না বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেউ কেউ বলছেন, যে দেশের পুঁজিবাজার যত উন্নত, সে দেশের অর্থনীতি তত উন্নত। তাই দেশের পুঁজিবাজার উন্নত করতে না পারলে কীভাবে দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে এবং আমরা কীভাবে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হব। আবার পুঁজিবাজারের বড় সমস্যা হচ্ছে ইনসাইডার ট্রেডিং। এটি বাজারে প্রকটভাবে দেখা যায়। ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের সঙ্গে বেশিরভাগ কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক এবং ওই কোম্পানির অডিটর জড়িত থাকেন। যদিও আইনে রয়েছে, কোম্পানির কোনো প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার দুই মাস আগে উদ্যোক্তা বা পরিচালক শেয়ার কেনাবেচা করতে পারবেন না। কিন্তু তারা তথ্যগুলো আগে থেকেই জেনে যাওয়ায় হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দেন। অন্য দেশের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, আইনের আওতায় এনে ইনসাইডার ট্রেডিংকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। আমাদের দেশে এ বিষয়ে আইন আছে ঠিকই; কিন্তু আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছেন তারা। কাজেই এ বিষয়ে জবাবদিহিতা বা স্বচ্ছতা না থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো যাবে না।
এদিকে, সাপ্তাহিক বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিদায়ী সপ্তাহে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ডিএসইএক্স সূচক ৩৪ পয়েন্ট বা ০.৬৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৩০ পয়েন্টে। অপর সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১২ পয়েন্ট বা ১.০২ শতাংশ এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৩০ পয়েন্ট বা ১.৬১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৪৫ ও ১৯২৪ পয়েন্টে। আর সপ্তাহজুড়ে ৩৫৪টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ১৫৯টির, কমেছে ১৭২টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২৩টির শেয়ার ও ইউনিট দর। এগুলোর ওপর ভর করে ৫ কার্যদিবসে ডিএসইতে ২ হাজার ১১৮ কোটি ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩৫৬ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের সপ্তাহ থেকে ৪৭৯ কোটি ৩৯ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৮ টাকা বা ১৮.৪৫ শতাংশ কম। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৫৯৮ কোটি ১৩ লাখ ২৩ হাজার ২৮৪ টাকার।
আর গত সপ্তাহে মোট লেনদেনের ৮৩ দশমিক ৯১ শতাংশই ছিল ‘এ’ ক্যাটাগরিভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দখলে। এ ছাড়া বাকি ৯ দশমিক ১১ শতাংশ ‘বি’, ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ ‘এন’ এবং দশমিক ৭১ শতাংশ ‘জেড’ ক্যাটাগরিভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের। আর গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪৫৭ কোটি টাকা। যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ২ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১২০ পয়েন্ট বা ০.৭২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৬৪২ পয়েন্টে। এছাড়া সিএসসিএক্স ৭৫ পয়েন্ট বা ০.৭৪ শতাংশ, সিএসই-৩০ সূচক ১৬১ পয়েন্ট বা ১.২২ শতাংশ, সিএসই-৫০ সূচক ১৬ বা ১.৩৩ শতাংশ এবং সিএসআই ১২ বা ১.০৭ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১০ হাজার ৮৬, ১৪ হাজার ৫২৮, ১ হাজার ২১৬ ও ১ হাজার ৮৭ পয়েন্টে। বিদায়ী সপ্তাহে সিএসইতে মোট ৩০৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের হাত বদল হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১২৮টির, দর কমেছে ১৫০টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ২৫টির। আর এগুলোর ওপর ভর করে সপ্তাহজুড়ে সিএসইতে ৩৭১ কোটি ৯৩ লাখ ৯১ হাজার ৭৫৫ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ১৮৩ কোটি ০৪ লাখ ৮৩ হাজার ৯০৯ টাকার। এ হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে সিএসইতে টাকার পরিমাণে লেনদেন ১৮৮ কোটি ৮৯ লাখ ৭ হাজার ৮৪৬ টাকা বা ১০৩ শতাশ বেড়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্ট-ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পুঁজিবাজারের সুশাসনের ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা পুঁজিবাজারে সুশাসন দেখতে চাই। একটি শক্তিশালী অর্থনীতির পাশাপাশি আমরা দেখতে চাই একটি বিকশিত পুঁজিবাজার। কাজেই পুঁজিবাজারের প্রতি সরকারের সুনজর থাকবে। তবে দেশে বহুজাতিক কোম্পানি অনেক রয়েছে এবং এর মধ্যে জাপানি কোম্পানি রয়েছে ২০০’র বেশি। এখনও পুঁজিবাজারে দুই হাজার কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। যে কোনোভাবে উদ্যোগ নিয়ে দেশি-বিদেশি মিলে যদি ৫০০ কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে বাজার এমনিতেই পরিবর্তন হয়ে যাবে। এখন অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন অর্থনীতির সঙ্গে সমান্তরাল গতিতে পুঁজিবাজারও এগিয়ে যাবে। অতএব সরকারকে এ বিষয়টিতে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।