চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) অধিকাংশ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। যদিও এর প্রভাব নেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ারদরে। গতকাল অধিকাংশ ব্যাংকের শেয়ারেই দরপতন হয়েছে। দর কমার প্রভাবে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের এদিন গড়ে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ লোকসান হয়েছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতকাল দিনের শুরুতেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল নিম্নমুখী। তবে দুপুরের দিকে সূচকে কিছুটা গতি আসে। ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় লেনদেন শেষ হলেও দিন শেষে ৩৬ দশমিক ৭০ পয়েন্ট হারিয়ে ৫ হাজার ৩৮৪ দশমিক ৯৩ পয়েন্টে দাঁড়ায় ডিএসই ব্রড ইনডেক্স।

তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের শেয়ারদর পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতকাল ২২ ব্যাংকেরই শেয়ারে দরপতন হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪ দশমিক ৭ শতাংশ দর হারিয়েছে প্রাইম ব্যাংক। ব্যাংকটির শেয়ার গতকাল দিন শেষে ১৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে, এর আগের দিন যা ছিল ১৯ টাকা।

চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে ১ হাজার ২২৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। গত বছরের একই সময় ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা হয়েছিল ১ হাজার ২১ কোটি টাকা। মুনাফা বৃদ্ধির পরও গতকাল ডিএসইতে ১ দশমিক ৭ শতাংশ দর হারিয়েছে ব্যাংকটির শেয়ার।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি খাতের আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি ৪০৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ২৮০ কোটি টাকা। তবে ডিএসইতে গতকাল ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে ১ দশমিক ১ শতাংশ।

পরিচালন মুনাফায় ভালো করেছে বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংকও। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে ৫০৫ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি ৪৫৬ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল। তা সত্ত্বেও ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে দেড় শতাংশ।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৫১০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। ২০১৮ সালের একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৪১৮ কোটি টাকা। আর ডিএসইতে ব্যাংকটির শেয়ার গতকাল ১ দশমিক ৬০ শতাংশ দর হারিয়েছে।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৩০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড। গত বছরের একই সময়ে ২৬০ কোটি টাকা মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি। ডিএসইতে ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে দশমিক ৭০ শতাংশ।

চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে ৩৬২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে এনসিসি ব্যাংক। বিদায়ী বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি ২৯৬ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছিল। এর শেয়ারদর কমেছে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৩৩১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ৩২৫ কোটি টাকা। তার পরও গতকাল ডিএসইতে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ দর হারিয়েছে ব্যাংকটির শেয়ার।

প্রিমিয়ার ব্যাংক পেয়েছে ২৫৪ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা। ২০১৮ সালের একই সময়ে ব্যাংকটি ২১২ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা পেয়েছিল। ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে ১ দশমিক ৭০ শতাংশ।

অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে ৩২০ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৩৩০ কোটি ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ২৮১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। ২০১৮ সালের একই সময়ে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা ছিল যথাক্রমে ২১১, ২৩৫ ও ১২৮ কোটি টাকা। গতকাল ব্যাংকগুলো যথাক্রমে ১ দশমিক ৬০, ১ দশমিক ৮০ ও ১ শতাংশ শেয়ারদর হারিয়েছে।

আগের বছরের তুলনায় ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৫৪০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ব্যাংকটি। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৪৪৭ কোটি টাকা। গতকাল ডিএসইতে ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে।

পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধি সত্ত্বেও শেয়ারদর কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকটকে দায়ী করেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল হালিম চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন নেতিবাচক বিষয় মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি করেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও ব্যাংকগুলোর মুনাফা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাছাড়া পরিচালন মুনাফা থেকে সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও কর পরিশোধের পর যা থাকবে সেটাই চূড়ান্ত মুনাফা। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণও কিন্তু বেড়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত সঞ্চিতি সংরক্ষণের পর মুনাফা কী দাঁড়ায়, সেটিও বিনিয়োগকারীরা বিবেচনা করছেন। এসব কারণেই অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বাড়ার প্রভাব ব্যাংকের শেয়ারদরে প্রতিফলিত হয়নি বলে আমার মনে হয়।

তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডিএসইতে গতকাল দর বেড়েছে কেবল ব্যাংক এশিয়া, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ও ট্রাস্ট ব্যাংকের। অপরিবর্তিত ছিল ঢাকা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের শেয়ারবাজারের সঙ্গে ফান্ডামেন্টালের কোনো সম্পর্ক নেই। যেখানে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে, সেখানে শেয়ারবাজারে এর বিপরীত চিত্র। অথচ বিদেশে কোনো ব্যাংকের সিইও পদত্যাগ করলেও শেয়ারদরে প্রভাব পড়ে। আর আমাদের দেশের শেয়ারবাজার তার নিজের নিয়মে চলে। এখানে অন্য কোনো নিয়ম খাটে না।

বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ইবিএল সিকিউরিটিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মুনাফা তুলে নেয়ার প্রবণতার কারণে অধিকাংশ বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর সংশোধন হয়েছে। তাছাড়া ঝুঁকিবিমুখ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে খাদ্য, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, টেলিযোগাযোগ এবং ওষুধ খাতের শেয়ার বিক্রির প্রবণতার কারণে এসব খাতে সেল প্রেসার বেড়েছে, যা সার্বিকভাবে সূচকের পতনে ভূমিকা রেখেছে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. শাকিল রিজভী বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বাড়লেও শেষ পর্যন্ত সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও কর প্রদানের পর নিট মুনাফা কত দাঁড়াবে, সেটি দেখার বিষয়। তাছাড়া ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ বাড়ার বিষয়টিও বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করেছে। পাশাপাশি যেসব বিনিয়োগকারী ব্যাংকের স্টক লভ্যাংশ পেয়েছেন, তারা তাদের শেয়ার বিক্রি করছেন। এসব কারণেই অধিকাংশ ব্যাংকের শেয়ারে দরপতন হয়েছে। আর খাতভিত্তিক বাজার মূলধনে শীর্ষে থাকায় ব্যাংকের শেয়ারে দরপতন প্রধান সূচকের পতনকে প্রভাবিত করেছে।

গতকাল ডিএসইতে মোট ৪৮২ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ১৪৩টির, কমেছে ১৭৪টির ও অপরিবর্তিত ছিল ৩৬টি কোম্পানির শেয়ারের। প্রধান সূচকের পাশাপাশি নির্বাচিত কোম্পানির সূচক ডিএস-৩০ আগের দিনের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫১ ও শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ৯ দশমিক ৫৩ পয়েন্ট কমেছে।