পুঁজিবাজারের গতিবিধি ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েই গেছে। একদিন সূচক বাড়ছে তো লেনদেন তলানিতে। আবার লেনদেনে খুব একটা গতি না দেখিয়ে সূচক টানা কমেই যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরাও বুঝে উঠতে পারছেন না কী করবেন। আগামীকাল সব পক্ষকে নিয়ে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন বিষয়ে বৈঠক করবেন অর্থমন্ত্রী। এমন খবরের পরেও আজ লেনদেন শুরুর দিকের সৃষ্ট পতনে অনেকে মনোবল হারিয়ে ফেলন। তবে শেষের দিকে সংশ্লিষ্টমহলের তৎপড়তায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচক কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু লেনদেনে ঠিকই দৈন্যদশা দেখা দিয়েছে। যাতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। মূলত তারা আগামীকালের বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত আসে সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছেন বলে ধারনা করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
এদিকে, নাজুক পরিস্থিতিতে আজ অন্যান্য খাতের যেখানে কোন প্রভাব নেই। সেখানে উল্টো ভেল্কি দেখিয়েছে বীমা খাত। আজ এ খাতে থাকা ৪৭টি কোম্পানির মধ্যে ৪৫টিরই শেয়ার দর বেড়েছে। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার দেশব্যাপী বীমা চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে বীমা কোম্পানিগুলোর কর্মকাণ্ড ব্যাপক আকারে সম্প্রসারিত হবে। কেননা দেশের উৎপাদনশীল কৃষি পণ্য ও গবাদি পশু বীমার আওতায় আসলে কৃষক ও খামারিরা যেমন নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। তেমনি বীমা কোম্পানিগুলোর আয়ের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে। এতে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর কর্মকাণ্ড দেশব্যাপী সম্প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, সরকারি কর্মচারীদের প্রচলিত গ্রুপ বীমার পরিবর্তে সমন্বিত জীবন বীমা ও প্রবাসীদের জন্য জীবন বীমা চালু করা হলে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর পরিধিও অনেক বিস্তৃত হবে। এমন প্রভাব এছাড়াও দীর্ঘদিন থেকেই তলানিতে থাকা এ খাতের শেয়ার স্বল্প দরে সংগ্রহ করেছেন চালাক-চতুর বিনিয়োগকারীরা।
আজকের বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের উত্থানে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন লেনদেনের শুরুতে উত্থান-পতন থাকলেও শেষ ঘন্টার ক্রয় চাপে সূচকে উত্থান ঘটে। রোববার লেনদেন শেষে সূচকের পাশাপাশি বেড়েছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। তবে টাকার অংকে লেনদেন আগের দিনের তুলনায় কিছুটা কমেছে। দিন শেষে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ৮ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ৪৯৪২ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১১৫৪ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ১ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ১৭৩৮ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৫২টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৮৪টির, কমেছে ১১৮টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৫০টির। আর দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ৩১৭ কোটি ৮ লাখ ৪২ হাজার টাকা।
এর আগের কার্যদিবস দিন শেষে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স ০.৭১ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করে ৪৯৩৩ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করে ১১৫৬৫ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ০.৮৭ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করে ১৭৩৭ পয়েন্টে। আর ওইদিন লেনদেন হয়েছিল ৪০৫ কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা। সে হিসেবে আজ ডিএসইতে লেনদেন কমেছে ৮৮ কোটি ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।
অন্যদিকে দিন শেষে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক ৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৯ হাজার ৯১ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ২৫৫টি কোম্পানির ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১২২টির, কমেছে ৯৪টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৯টির। আর দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ৩২ কোটি ২১ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।
বাজার সংশ্লিষ্ট-ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের পুঁজিবাজারে কয়েক শ্রেণির বিনিয়োগকারী রয়েছেন। এর মধ্যে কিছু বিনিয়োগকারী রয়েছেন যারা অন্য পেশায় থাকলেও পুঁজিবাজার বোঝেন ও খোঁজ-খবর রাখেন। তারা নিয়মিত লেনদেন না করলেও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করেন। ক্যাপিটাল গেইনের পাশাপাশি বছর শেষে ডিভিডেন্ড তুলে দুভাবেই মুনাফা করেন তারা। সংখ্যায় কম হলেও প্রকৃত অর্থে এরাই বিনিয়োগকারী। আর একটি শ্রেণি রয়েছে, যাদের মূল পেশাই শেয়ার বিনিয়োগ। এরা প্রতিদিন বাজারে আসেন, নিয়মিত লেনদেন করেন। বাজার তেমন না বুঝলেও অন্যের পরামর্শে এক শেয়ার বিক্রি করে অন্যটা কেনেন। গুজবে কান দিয়ে লেনদেন করেন। বছরের পর বছর ব্যবসা করেও তারা তেমন সুবিধা করতে পারেন না। তাদের বিনিয়োগকারী না বলে ডে-ট্রেডার বলাই ভালো। পুঁজিবাজারে ধস নামলে এই শ্রেণিটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের পুঁজিবাজারে এই শ্রেণির বিনিয়োগকারীর সংখ্যাই বেশি। আরেক শ্রেণির বিনিয়োগকারী রয়েছেন, তারা বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রাখেন। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগেই জেনে যান তারা। নিশ্চিত খবর পেয়ে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফাও বের করে নেন। সংখ্যায় অল্প হলেও এরা বেশ পেশাদার। কোম্পানির আদ্যপান্ত তাদের নখদর্পণে। এ ব্যবসা করেই এখন অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন তারা। দেশের পুঁজিবাজারে এরাই সবচেয়ে সুবিধাভোগী। কিছুকাল আগেও এরা বিভিন্ন কোম্পানির এজিএমে উপস্থিত হতো পাবলিক গাড়িতে চড়ে আর এরাই এখন কোম্পানির এজিএমে যান নিজের প্রাইভেট গাড়িতে কোম্পানির পরিচালক হিসাবে। কোম্পানি লসে থাকুক আর বাজারে শেয়ার দর ধসে থাকুক এদের ইনকাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে পকেটে ঢুকে যায়। এদের কেউ কেউ অফিস নিয়েও শেয়ার বিনিয়োগ করছেন। সম্প্রতি নেয়া কিছু সিদ্ধান্তের মত এদের বিষয়েও বিএসইসির নজরদারি বাড়ানো অতীব জরুরী। এদের কারনেই নানা প্রকার অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার। বিশ্লেষকদের বিশ্বাস, এই শ্রেনীটিকে রুখতে পারলে কোম্পানিগুলো যেমন মুক্ত হয়ে যাবে তেমনি প্রকৃত বিনিয়োগকারীরাও মর্যাদা লাভ করবেন। তখন বাজারেও গতি আসবে।