দীর্ঘদিন ধরেই তারল্যসংকট চলছে দেশের পুঁজিবাজারে। কমে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগ। পতনে প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে কেবলই লোকসান গুনতে হচ্ছে। কমছে শেয়ারের দাম আর বাড়ছে লোকসানের পরিমাণ। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে পুঁজিবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে না। এরই ধারাবাহিকতায় আজ দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) রিকভার মুডে থাকা সূচকটিও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। অর্থাৎ আজ ডিএসইর প্রধান সূচকটি শেষ মিনিটে ২০ পয়েন্টের বেশী পতন হয়েছে। অথচ শেষ মিনিটে পতনে বদলে সূচকটিতে যদি মাত্র ১০ পয়েন্টের উত্থান হত, তাহলেও কিছুটা স্বতি পেতেন বিনিয়োগকারীরা! বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার ডিমিউচুয়ালাইজেশন করার মাধ্যমে যে স্বতন্ত্র পরিচালকরা দায়িত্ব পালনে এলেন, সে স্বতন্ত্র পরিচালকরা বাজারে কতটুকু স্বাধীনভাবে তাদের ভূমিকা পালন করছেন; এটি ভেবে দেখার সময় এসেছে। বিশ্বের নামকরা চীনের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ বাজারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা কতটুকু বাজারে ভূমিকা রাখছে বা তাদের ভূমিকা রাখতে দিচ্ছে না বা তাদের উৎসায়িত করা হচ্ছে না। এটাও কিন্তু আমাদের এক ধরনের ব্যর্থতা। তাছাড়া বাজারসংশ্লিষ্ট অনেক ভালো আইনকানুন রয়েছে। কিন্তু সে আইনকানুন বাজারে যথার্থভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। আবার যেখানে জিডিপির গ্রোথ ও অর্থনীতির আকার বাড়ছে কিন্তু ক্যাপিটাল মার্কেটে ভালো মানের কোনো বন্ড নেই বা আনা হচ্ছে না। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোও বাজারে আসছে না। এক্ষেত্রে এখানে সরকারের নীতিনির্ধারকরা যতটা উদাসীন, তার চেয়ে বেশি উদাসীনতা রয়েছে আমলাদের। যা বাজার গতি আরও নেতিবাচক করছে বলেও মনে করছেন তারা।
কেউ কেউ বলছেন, পুঁজিবাজারে প্রায় ৫৮টি মার্চেন্ট ব্যাংক রয়েছে। প্রত্যেকটির মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রতি বছর দুটি কোম্পানি বাজারে আনার বাধ্যবাধকতা আছে বলেই, তাদের লাইসেন্স বাতিলের রক্ষার ক্ষেত্রে যেনতেনভাবে একটি কোম্পানি এনে দায়সারা কাজ করছে। আসলে বেশিরভাগই মার্চেন্ট ব্যাংক এ কাজটি করে থাকে। আবার দেশে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে কয়টি কোম্পানি বাজারে আসছে। ওইসব কোম্পানি ভালো ব্যবসা এবং প্রফিট করছে। কিন্তু বাজারে তা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। আসলে এখানে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছার অভাব। যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকত তাহলে বাজারের দুর্বল কোম্পানিগুলো আসত না। কাজেই বাজার ভালো করতে সরকারের একান্ত সদিচ্ছা জরুরি বলেও ধারনা তাদের।
এদিকে, আজকে বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের পতনে শেষ হয় লেনদেন। এদিন লেনদেনের শুরুতে উত্থান থাকলেও কিছুক্ষণ পর সৃষ্ট বিক্রয় চাপে টানা নামতে থাকে সূচক। বুধবার লেনদেন শেষে সূচকের পাশাপাশি কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। তবে টাকার অংকে লেনদেন আগের দিনের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। দিনশেষে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ৩০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪৬৯১ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১০৭৫ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ১৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৬৪৫ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৪০টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৩২টির, কমেছে ১৬১টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৭টির। আর দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ৪০৬ কোটি ৩৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা।
অথচ এর আগের কার্যদিবস দিন শেষে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স ০.৩৫ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করে ৪৭২২ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করে ১০৮৬ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ৯ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করে ১৬৬১ পয়েন্টে। আর ওইদিন লেনদেন হয়েছিল ৩৮০ কোটি ৮৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। সে হিসেবে আজ ডিএসইতে লেনদেন বেড়েছে ২৫ কোটি ৫১ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, দিনশেষে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক ৪৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৮ হাজার ৬৭০ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ২৪১টি কোম্পানির ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৯১টির, কমেছে ১১১টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৯টির। আর দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ১৫ কোটি ৬১ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
বাজার সংশ্লিষ্ট-ব্যক্তিরা বলছেন, গত ১০ বছরে পুঁজিবাজারে নীতিগত অনেক বিষয় সংশোধন করা হয়েছে। অনেক বিষয় সংশোধন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়েছে কতটুকু হয়েছে সেটাই প্রশ্ন। তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি, যারা বিভিন্ন সময়ে শেয়ার কেনাবেচায় কারসাজি করেছে তাদের কোনো শাস্তি দিতে দেখা যায়নি। গত এক থেকে দুবছরে যেসব কোম্পানি বাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সত্যিকার অর্থে সেগুলো বাজারে আসার মতো নয়। আবার বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য তেমন কোনো কোম্পানি আনতে পারেনি। মার্চেন্ট ব্যাংকসহ ডিএসই, সিএসইসি এবং বিএসইসি এ দায় এড়াতে পারে না। আর ব্যাংক, আর্থিক এবং বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে সমস্যা রয়েছে, তার সমাধান সহজে হবে না। কেননা এর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে হলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ বাদ দিয়ে দেশের সামগ্রিক স্বার্থ বিবেচনা করে অপরাধীদের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজার ভালো করা সম্ভব। কাজেই পুঁজিবাজারের কল্যাণে এসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ বাদ দেয় জরুরি বলেও মত দিয়েছেন তারা।