দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর বাংলাদেশ ব্যাংক তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ কে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা থেকে বাদ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। যার ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রায় ২০ হজার কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগযোগ্য হয়েছে। যদিও বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন তারল্য সঙ্কটে। তবে ধারনা করা হচ্ছে, ২০১০ সালের পর এটি পুঁজিবাজারের জন্য সবচেয়ে বড়ো প্রণোদনা। এছাড়াও পুঁজিবাজার উন্নয়নে বর্তমান সময়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তাতে চলতি মে মাস হতে পারে আগামী ২-৩ বছরের জন্য বাজার সাজানোর মাস। কেননা গত সপ্তাহেই সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ২টি আলাদা কমিটি করে দিয়েছে পুঁজিবাজার উন্নয়নে। ১টি কমিটির কাজ হলো যে সব কোম্পানীর পরিচালকদের শেয়ার হোল্ডিং সমন্বিতভাবে ৩০ শতাংশ ও একক ভাবে ২ শতাংশের কম তাদের জন্য শেয়ার ধারন সংক্রান্ত আইন পুনর্বহাল করা। তাছাড়া ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সীমা ২০১০এ টেনে ধরার পর আর পুনর্বহাল হয়নি যেটা ছিলো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অন্যতম দাবী।

অন্যদিকে, অর্থমন্ত্রী নিজে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আগামী বাজেটের জন্য ইতিবাচক প্রস্তাবনা চেয়েছেন যার ইতিবাচক প্রতিফলন হয়তো আগামী বাজাটে দেখা যাবে। অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে আগামীর বাজেট হবে পুঁজিবাজার বান্ধব। বাজেটে চাওয়ার চেয়েও বেশি পাবে বিনিয়োগকারীরা। অনেকেরই ধারনা এই চমকটি হতে পারে পুনরায় এক দুই বছরের জন্য পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ। পাশাপাশি কেপিট্যাল গেইন ট্যাক্সও পরিবর্তন হতে পারে। অবস্থা দৃষ্টে রাজস্ববোর্ড, বিনিয়োগবোর্ড, ডিবিএ, বিএসইসি সবাইকে কেন যেন হঠাৎ পুঁজিবাজারবান্ধব মনে হচ্ছে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক দাঁড়িয়েছিল ২৭৯৫ পয়েন্ট এবং বাজার মুলধন ছিল ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। এর আগে প্রায় টানা ধরপতনে দিশেহারা হয়ে উঠেছিল শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা। ১৯৯৬ সালের পর মার্কেট বিমুখ হয়ে গিয়েছিল বিনিয়োগকারীরা। ২০০৬ সালে প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের অনুমতি পায়। এটাই ছিলো তৎকালিন বাজারকে ফুলিয়ে উঠানোর মূলমন্ত্র। এরই ধারাবাহিকতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১০% বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করে ৩০% পর্যন্ত বিনিয়োগ করে ফেলে। এর একটাই কারণ ছিলো সেটা হলো পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাব। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সাল শেষে বাজার মূলধন দাড়ায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটিতে এবং ২০১০ সালে মুলধন দাঁড়ায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। কিন্তু ২০১০ এর শেষ দিকে এসে নিয়ন্ত্রন সংস্থার শুভবুদ্ধির উদয় হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে লাগাম টেনে ধরে। যার কারণে বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় ২ লাখ কোটি টাকা যা দিয়ে তখনকার সময়ে বাংলাদেশের ২ টা বাজেট দেওয়া যেতো। সর্বোপুরি অনিয়ন্ত্রিত বাজারের ফলে নেমে আসে প্রলয়ঙ্কারী ধস ২০১০।

২০১০ এর মহা ধসের পর এমনি করে কেটে গেল ৯ টি বছর। নিয়ন্ত্রক সংস্থার খামখেয়ালির কারণে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি শেয়ার মার্কেট। ২০১৮ তে এসে ডিএসই তাদের স্ট্রেটেজিক পার্টনার হিসেবে পেল চায়নাকে। এরই মধ্যে আমরা দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর পেলাম নতুন অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালকে। যার ফলশ্রুতিতে অসহায় বিনিয়োগকারীরা আবার আশায় বুকবাঁধতে শুরু করে। কিন্তু কিছুতেই রেহায় পায়নি সূচকের পতন। একটানা ৩ মাসের ধরপতনে ডিএসইর সূচক কমে প্রায় ৭০০ পয়েন্ট কমে যেটা ২০০৮ এ শেয়ার মার্কের ঘুরেদাঁড়ানোর আগের চিত্র ছিল। এই টানা ধরপতন থেকেই মূলত ২০০৮ এর মতো মার্কেটের সাজ শুরু। এরই মধ্যে সৌদি আরব বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ৪০০০ কোটি বিনিয়োগে আগ্রহী। তাছৃড়া চীনের কাছে ২৫% শেয়ার বিক্রির টাকাও বাজারে বিনিয়োগ হয়েছে। নতুন করে ২০১৯ এর মে মাসে এসে আইসিবি কে আরো ৮৫৬ কোটি টাকার ফান্ড দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। তবে দীর্ঘদিনধরে বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বড় দাবীছিল দূর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানীর আইপিও বন্ধ করা যেটার তৎপরতা এরই মধ্যে কিছুটা দৃশ্যমান। মাঝপথে এসে আবার বুকবিল্ডিং আইন বাস্তবায়নের ফলে প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। নতুন কোম্পানী বাজারে আসলেই প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিক প্লেসমেন্ট হোল্ডাররা শেয়ার বিক্রি করে উদাও। তাই নতুন করে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়৷ তাছাড়া ৫০ কোটি টাকার কম মুলধনের কোম্পানির জন্য নির্ধারণ করা হয় ফেসভেলুতে আর ১০০ কোটি টাকা মূল্যের কোম্পানীর জন্য প্রিমিয়ামের ভিত্তিতে লিস্টেড হওয়ার নতুন নিয়ম। তাছাড়া প্লেসমেন্ট শেয়ারের উপর ৩ বছরের নিষেধাজ্ঞা জারীর প্রস্তুতি চলছে। এসবই কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাজার ভালো করার মন্ত্র। অবস্থা দৃষ্টে বলা যায় বিএসইসি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পুঁজিবাজারে অনেক সংস্কার হচ্ছে। এবং এ চেয়ারম্যান বিভিন্ন স্থানে কমিউনিকেশনের মাধ্যমে যেসব সংস্কার এনেছেন যা পুঁজিবাজারকে ফাপিয়ে তুলবে। আর সূচক দশ হাজার পয়েন্টে নেয়ার যে প্রতিজ্ঞা সেটা পূরণ হতে এখন আর খুব বেশি দেড়ি হবে না।

আমরা বিনিয়োগকারীরা আশার তীর্থ যাত্রী। তাই যে কোন ঘোষণায় যেন আমাদের শুকনো হৃদয়ে আশার সঞ্চার করে। তাই অর্থমন্ত্রী, বিএসইসি, বিএবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিবিএ সহ সকল অঙ্গ সংঘঠনের কার্যকলাপে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বিনিয়োগকারীরা৷ ধারনা করা হচ্ছে সকল কম্পোনেন্ট একসাথে কাজ করলে ২০১৯ সালের জুলাইয়ের পর থেকে বাজারে উর্ধ্বমুখীভাব শুরু হবে যেটা চলতে পারে ২০২১ সাল পর্যন্ত।