গোটা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একসময় এগিয়ে নিলেও এখন কঠিন ভরাডুবি চলছে দেশের পুঁজিবাজার। দরপতনের কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত পুঁজি হারাচ্ছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। পুঁজি হারানো এসব বিনিয়োগকারী দুরবস্থায় অনেকটাই দিশেহারা। কয়েক মাস ধরে চলা এ দরপতনের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিলেও এর পেছনের যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকেই। তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কারসাজি চক্রকে দায়ী করছেন। দরপতনের প্রতিবাদ ও কারসাজি চক্রের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধনও করেছেন তারা। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ চলছেই। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, মুখ থুবড়ে পড়া পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা দিনের পর দিন বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করলেও নীরব থাকছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। চলমান ভয়াবহ দরপতনে মতিঝিলের ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আনাগোনাও কমে গেছে। আজ বেশ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজ ঘুরে হাতেগোনা কয়েকজন বিনিয়োগকারীকে দেখা যায়। বেশিরভাগ ব্রোকারেজ হাউজে একসঙ্গে দু-তিনজন বিনিয়োগকারীর দেখা মিলেছে। অথচ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও এসব ব্রোকারেজ হাউজ বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে জমজমাট ছিল। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, পুঁজিবাজারের দরপতনে প্রতিনিয়ত আমাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমাদের এ রক্তক্ষরণ দেখার কেউ নেই। দিন যত যাচ্ছে ততই হতাশার মধ্যে পতিত হচ্ছি। পুঁজিবাজারের কথা মনে পড়লে মাঝে মধ্যে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। এরপর টেনশনে সারারাত ছটফট করি, ঘুম আর আসে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাস্ততসম্মত এবং যুগোপযোগী কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। জোড়া-তালির পদক্ষেপ নিয়ে পুঁজিবাজারে গতি ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যে কারণে ফল পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও রেপোর মাধ্যমে তারল্য সরবরাহের যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, কয়টি ব্যাংক সে সুবিধা নিয়েছে সেটাই প্রশ্ন। আইসিবি বিনিয়োগ করলে, তার পরিমাণ খুব বেশি না। আবার ব্রোকারেজ হাউজগুলোতেও টাকা নেই। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই। বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারবিমুখ হয়ে গেছেন। ফলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাজারে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ বাজারে দ্রুত তারল্য সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য পুঁজিবাজার ভালো করতে হলে দেশি-বিদেশি ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতের যে সমস্যা রয়েছে তারও সমাধান করতে হবে। তা না হলে বাজারের মন্দা অবস্থা কাটানো কঠিন হবে।
এদিকে, আজকের বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন লেনদেনের শুরু থেকেই সেল প্রেসারে কমতে থাকে সূচক। মঙ্গলবার লেনদেন শেষে সূচকের পাশাপাশি কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। আর টাকার অংকেও লেনদেন আগের দিনের তুলনায় কিছুটা কমেছে। দিনশেষে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ৫২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪৭০৮ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৮ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১০৮০ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ১৪ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৬৬০ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৫২টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৩০টির, কমেছে ২৯২টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩০টির। আর দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ২৮৮ কোটি ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।
এর আগের কার্যদিবস দিন শেষে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স ২০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করে ৪৭৬১ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করে ১০৮৯ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ১০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করে ১৬৭৫ পয়েন্টে। আর ওইদিন লেনদেন হয়েছিল ৩৫০ কোটি ৪৯ লাখ ১৮ হাজার টাকা। সে হিসেবে আজ ডিএসইতে লেনদেন কমেছে ৬২ কোটি ১২ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, দিনশেষে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক ৯৭ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৮ হাজার ৭০৮ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ২৪০টি কোম্পানির ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২৬টির, কমেছে ১৯৩টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২১টির। আর দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ১০ কোটি ৬৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।
বাজার সংশ্লিষ্ট-ব্যক্তিরা বলছেন, কেউ যদি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হন, তাহলে এখনই সেরা সময়। কারণ, ক্রমাগত দরপতনে বেশির ভাগ শেয়ারের দাম গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। সার্বিকভাবে বাজারের মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও অনেক নিচে রয়েছে। তাই হাতে টাকা থাকলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পরে এখনই। তবে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের সবটুকু পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না। বেশির ভাগ টাকা নির্দিষ্ট ও নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাকি অর্থ নিয়ে পুঁজিবাজারে আসতে পারেন। তবে সতর্ক থাকতে হবে শেয়ার কেনায়। দর কম দেখে লাফ দিয়ে কোনো শেয়ার ক্রয় করা যাবে না। বাজারে কম দামে এমন অনেক শেয়ার আছে, যেসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই দাম কম মানেই বিনিয়োগযোগ্য শেয়ার, তা ভাবার সুযোগ নেই বলেও মনে করছেন তারা।