২০১০ সালের পর থেকে আজ অবধি বিভিন্ন সময় পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও বার বার দরপতনের বৃত্তে ঘূর্ণায়মান। মাঝে মধ্যে বাজারে কয়েকবার আশার আলো উকি মারলেও তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোকসান কমার বদলে বাড়ছে। মুলত গুজব, আস্থার সঙ্কট, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ব্যাংকিং খাতের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ডে-ট্রেডারের মতো আচরণ, কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম, নির্ধারণী মহলের দায়সারা মনোভাব বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, ২০১০ সালের ধসেই বিনিয়োগকারীরা তাদের কষ্টার্জিত পুঁজি হারিয়েছে। পরবর্তীতে নীতি নির্ধারণী মহলের আশার বানীতে অসংখ্য বিনিয়োগকারী হারানো পুঁজি ফিরে পাওয়ার আশায় নতুন করে বিনিয়োগ করলে লোকসানের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

তবে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। সকলের মাঝে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া বর্তমান বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই নিম্নমুখী হচ্ছে বাজার। সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কমছে বাজার মূলধন।

বিষয়টি যেমন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলছে, ঠিক তেমনি বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এর প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে। আর এ কারনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বাজারের ভারসাম্য ধরে রাখতে ইনভেষ্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) সহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

তবে পুঁজিবাজারের হঠাৎ এ দরপতকে সরলভাবে নিতে পারছেন না দক্ষ বিনিয়োগকারীরা। তাদের দাবি, পুঁজিবাজারের এ দরপতনের পেছনে আবারও কোনো কারসাজি চক্র সক্রিয়, বিএনপি জামায়াতপন্থী ব্রোকারেজ হাউজগুলোর মালিকরা পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করতে চায় তা দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খতিয়ে দেখতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগকারীরা আবারও বড় লোকসানের মুখে পড়বেন।

এদিকে পুঁজিবাজার টানা দরপতনে সাধারন বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিদিন অধিকাংশ শেয়ারের দর কমলেও হাতেগোনা কিছু শেয়ারের দর বাড়িয়ে সূচক কে সাপোর্ট দিয়ে রাখা হচ্ছে। যেখানে গত দুই মাস আগেও গড়ে দৈনিক ১০০০ থেকে ১২০০ কোটি টাকা লেনদেন হতো, সেখানে বর্তমানে লেনদেন পৌঁছেছে গড়ে ৫০০ কোটির ঘরে।

তেমনি গত দেড় মাস যাবৎ কোনদিন কখনো ব্যাংক বা ইন্সুরেন্স আবার কখনো বহুজার্তিক শেয়ার দিয়ে সূচক কে সাপোর্ট দিয়ে রাখা হলেও অন্যান্য খাতের শেয়ারের অব্যাহত দরপতনে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। গত দুই কার্যদিবস ধরে ৫০ থেকে ৬০ টি কোম্পানির শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে ২৫০ এর অধিক কোম্পানির দর পতন হয়।

এক্ষেত্রে কোন শেয়ারের অব্যাহত দর বৃদ্ধির কারণে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও অব্যাহত দরপতন হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই ব্যাপারে নিশ্চুপ ভুমিকা থাকে বলে বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন। বর্তমান বাজারের এ সংকট থেকে উত্তরণে জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিএসই ও আইসিবি দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছেন বিনিয়োগকারীরা।

পুঁজিবাজার টানা দরপতন হওয়ার পেছনে প্রধানত চারটি কারণ বিদ্যমান বলে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ ও দেশ প্রতিক্ষণ ডটকমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ, দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ এবং বড় ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথায় এ চারটি কারণ উঠে এসেছে।

প্রথমত, বর্তমান পুঁজিবাজারের চিত্রের সঙ্গে অর্থনীতির সূচকের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ অর্থনীতির সব সূচকই ইতিবাচক রয়েছে। তারপরও প্রতিনিয়ত পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ বাড়ছে। টানা পতনের পাশাপাশি লেনদেনও নেমে গেছে ৫০০ কোটি টাকার ঘরে। মূলত আমাদের পুঁজিবাজারে কাঠামোগত কিছু বিষয়ে সমস্যা রয়েছে।

তবে আগের চেয়ে বেশি আইপিও আসার পাশাপাশি বর্তমানে যে কোম্পানিগুলো আসছে সেগুলো মানসম্মত নয়। কাজেই মন্দা বাজারে যদি কয়েক মাসের জন্য আইপিও আসা বন্ধ করে দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে সেকেন্ডারি মার্কেটে কিছুটা গতি আসবে। কারণ অতীতেও এটি করা হয়েছিল, তখন বাজার ইতিবাচক হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে কোনো কোনো মহল। তারা বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকতে বা বিনিয়োগ উঠিয়ে ফেলার জন্য গুজব ছড়াচ্ছে যে, সামনে শেয়ারের দাম আরও কমবে। এগুজবের সাথে ডিএসই বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজ জড়িত। এরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পুঁজিবাজার ইস্যুতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। এ ব্যাপারে বিএসইস’র সজাগ থাকা উচিত। তা না হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে বিনিয়োগকারীরা।

তৃতীয়ত, সার্বিকভাবে দেশ উন্নয়নে দিকে এগিয়ে যাচেছ। গত কয়েক বছরে সব সূচকের উন্নতির সঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দ্বিগুণ হয়েছে। বেড়েছ মোট জাতীয় আয়ও (জিএনআই)। তবে জিডিপির উন্নয়নের সঙ্গে সমানতালে এগোয়নি পুঁজিবাজার। অর্থনীতির আকার বাড়লেও অনেকটা পেছন পানে হাঁটছে ২৬ লাখের বেশি বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজার।

অনেকে পুঁজিবাজার থেকে মুখও ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক সময় শেয়ারবাজার ইতিবাচক ধারায় ফেরার চেষ্টা করলে এই বিনিয়োগকারীরা ফিরে এসে কয়েক দিনের মধ্যে আবার হতাশ হয়ে ফিরে যায়। এই আস্থার অভাবেই পুঁজিবাজার অস্থিরতার নেপথ্যে কারন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চতুর্থত, ব্যাংক, পোটফলিও ম্যানেজমেন্ট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারকে বরং নেতিবাচক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অব্যাহত পতনের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে লোকসানের পাল্লা ভারি করছেন। অন্যদিকে, সরকারের দায়িত্বশীল রেগুলেটেড প্রতিষ্ঠানের কঠোর কিছু পদক্ষেপ বাজারকে কারসাজি চক্রের ফায়দা হাসিলে ভুমিকা রাখছে বলেও মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারের বর্তমান অবস্থা ১৯৯৬ সালের চেয়েও ভয়াবহ। ১৯৯৬ সালের বাজারে ঋণের কোনো বিষয় ছিল না। তখনকার বাজারে বিনিয়োগকারীদের পুরোটাই ছিল তাদের নিজস্ব বিনিয়োগ। তাই তখন যারা শেয়ার নিজের নামে হস্তান্তর করে অপেক্ষা করেছিলেন, তারা দীর্ঘ সময় পর হলেও মুনাফা পেয়েছেন।

বাজার সংশ্লিষ্ট-ব্যক্তিরা বলছেন, আমাদের বাজারের প্রধান সমস্যা আস্থার ঘাটতি। দেশের ১৬ কোটি মানুষের সবাই কমবেশি সঞ্চয়কারী। এসব সঞ্চয়কারীর আগ্রহ এ বাজারের প্রতি নেই। ব্যাংকের নানা অনিয়ম, দুর্নীতির পরও মানুষ ওখানেই টাকা রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত সরাসরি সঞ্চয়কারীদের টাকা বাজারে আসবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত নানা কায়দাকানুন করে ব্যাংকের মাধ্যমে কিছু অর্থ বাজারে এনে হয়তো সাময়িকভাবে বাজারকে কিছুটা এগিয়ে নেওয়া যাবে।

তবে এভাবে খুব বেশি দূর যাওয়া যাবে না। আমরা দেখছি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি দেশজুড়ে বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে এ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান বাজারে যেসব শিক্ষিত, জানা–বোঝা বিনিয়োগকারী আছেন, তাঁদেরই কোনো আস্থা নেই। সেখানে বাজারে আস্থা তৈরির আগে এ ধরনের বিনিয়োগ শিক্ষা কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না।

মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়শনের সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক জেগে ঘুমাচ্ছে। অর্থমন্ত্রীও বাংলাদেশ ব্যাংককে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সহযোগিতায় করার জন্য বলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা করছে না। সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। তারা তাদের সাবসিডিয়ারির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারেও বলে মনে করেন তিনি।

বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ডিবিএ প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদ সাদেক বলেন, পুঁজিবাজার দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। গুজবে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাজার যেকোন দিন ঘুরে দাঁড়াবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক পরিচালক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে একদিকে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, অন্যদিকে সেগুলোতে বাধা দেওয়া হয়। ২০১০ সালে ধসের পর অনেক সংস্কার হয়েছে। বারবার ধাক্কায় বাজারের ভিত নড়ানো হয়েছে। আর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর আস্থা ফেরাতে না পারায় তারাও শেয়ার বিক্রি করছে। যেকোনো মূল্যেই বাজারের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, প্লেসমেন্টে নানা অনিয়ম হচ্ছে। তবে তা দেখার কেউ নাই। এক্ষেত্রে কয়েকজন ব্যক্তি স্বার্থে শেয়ারবাজারকে আরেকটি মহাধসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেটা বর্তমানে শেয়ারবাজারের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। যে বিষয়টি আজকে ডিএসইর পর্ষদ সভায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে।

প্লেসমেন্টের অনৈতিকতা বন্ধ করা না গেলে, শেয়ারবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে। ফলে আগামিতে প্লেসমেন্ট শেয়ারে ৩ বছর লক ইন করার শর্তে আইপিও অনুমোদন দেওয়ার জন্য বিএসইসিতে ডিএসই সুপারিশ করবে বলে আজকের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। একইসঙ্গে প্লেসমেন্টের বিপরীতে প্রাপ্ত বোনাস শেয়ারেও ৩ বছর লক ইন করার শর্ত দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারকে কার্যকর করতে কিংবা যথাযথভাবে গড়তে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। বর্তমান পুঁজিবাজারে দুর্বল মৌল ভিত্তি কোম্পানির আইপিওর হিড়িক পড়ছে। মৌল ভিত্তির কোম্পানি বাজারে এলে বিনিয়োগকারীও আকৃষ্ট হবে। গতিশীল ও কার্যকর বাজার গড়ে তুলতে কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। যদিও একটি তালিকাভুক্তিতে অনেক সময় ও জটিলতা রয়েছে। বাজারে বহুজাতিক ও সরকারি কোম্পানি আনা খুব জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সংকটে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স

পুঁজিবাজারের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার কারণে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেড সংকটে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির তিনটি সাবসিডিয়ারি রয়েছে, যাদের আয়-ব্যয়ের ওপর মূল কোম্পানির মুনাফা নির্ভর করে। এগুলোর আয় কমে যাওয়ায় ২০১৮ সালে মূল কোম্পানির নিট মুনাফা কমেছে ৭৭ শতাংশ। সাবসিডিয়ারি ছাড়াও মূল কোম্পানিকেও ২০১৮ সালে নানামুখী চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।

তিন সাবসিডিয়ারির মধ্যে ২০১৮ সালে লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ৫১ কোটি টাকা লোকসান করেছে। অপর সাবসিডিয়ারি হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ পুঁজিবাজারে শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউস। গত বছর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) দৈনিক গড় লেনদেন কমে যাওয়ায় এর কমিশন ও ব্রোকারেজ আয় কমেছে ৩৮ শতাংশ। আরেক সাবসিডিয়ারি লংকাবাংলা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লোকসান করেছে ৪ কোটি টাকার বেশি। মূলত পুঁজিবাজারে লেনদেন ও বিনিয়োগ মূল্য কমে যাওয়ায় সাবসিডিয়ারিগুলোর আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৮ সালে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ সময় ডিএসইতে গড় লেনদেন ৩৮ শতাংশ কমে।

লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্রোকারেজ আয় কমে যাওয়া, মন্দঋণ ও বিনিয়োগ করা শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ায় ২০১৭ সালের চেয়ে ৭৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৯৭ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। অন্য সিকিউরিটিজ থেকে মূলধনি মুনাফা ও লভ্যাংশ আয় কমেছে প্রায় ৫৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা শাহরিয়ার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির কারণে পুঁজিবাজারের ওপর আমরা অনেকটা নির্ভরশীল। ধীরে ধীরে পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনছি। আমরা ব্যবসা বহুমুখীকরণের অংশ হিসেবে এসএমইতে মনোযোগী হচ্ছি। আগামীতে আমাদের কোর ব্যবসা হবে এসএমই।’

তিনি বলেন, সম্পদ ও দায়ের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ‘মোটামুটি ভালো’ হলেও পুঁজিবাজারে খারাপ হয়েছে। আগের বছর মুনাফার বড় অংশই আসে ব্রোকারেজ কমিশন ও পুঁজিবাজার বিনিয়োগ থেকে। কিন্তু ২০১৮ সালে এ খাত থেকে আশানুরূপ ব্যবসা হয়নি। দুটি সাবসিডিয়ারির লোকসান নিট মুনাফায় বেশি প্রভাব ফেলেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের লোকসান মেটাতে গিয়ে মুনাফা কমে গেছে।

এদিকে ২০১৮ সালে পুঁজিবাজার থেকে আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি মূল কোম্পানির ব্যবসাও ভালো যায়নি। এ সময় লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের আমানত সংগ্রহ যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে ঋণ বিতরণের পরিমাণও। ২০১৭ সালে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। কিন্তু ২০১৮ সালে উল্টো ৬২ কোটি টাকা আমানত প্রত্যাহার হয়। আমানত সংগ্রহ করতে না পারায় ঋণ বিতরণও আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ২১৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৮৬ শতাংশ কম। ২০১৭ সালে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স বিভিন্ন খাতে মোট ১ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে।

খাজা শাহরিয়ার বলেন, ‘তারল্য সংকট পুরো আর্থিক খাতেই ছিল। এ কারণে আমাদেরও আমানত সংগ্রহ কমেছে। যেহেতু পর্যাপ্ত আমানত সংগ্রহ করতে পারিনি, তাই ঋণ বিতরণের পরিমাণও কমেছে। তবে আমরা এখন বিকল্প অর্থায়নের উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছি। এরই মধ্যে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে।’

ঋণ বিতরণ কমলেও ২০১৮ সালে সুদ বাবদ আয় বেড়েছে। নিট সুদ আয় হয়েছে ২৪৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা আগের বছর ছিল ২২৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তবে বিনিয়োগ, কমিশন, ব্রোকারেজ ও অন্যান্য আয় কমে যাওয়ায় কোম্পানির পরিচালন মুনাফা গত বছর ১৩ শতাংশ কমেছে। এ সময় পরিচালন মুনাফা হয় ৪৪৫ কোটি টাকা। মন্দঋণ ও বিনিয়োগ করা শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ায় ২০১৮ সালে ৯৭ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এতে প্রশাসনিক খরচ বাদ দেওয়ার পর কোম্পানির কর-পূর্ববর্তী মুনাফা দাঁড়ায় ৭০ কোটি ৯০ লাখ টাকায়, যা আগের বছর ছিল ২২৬ কোটি টাকা। আর কর দেওয়ার পর নিট মুনাফা দাঁড়ায় ৪৪ কোটি টাকা, যা ২০১৭ সালে ছিল ১৯২ কোটি টাকা। ধারাবাহিকতা ধরে প্রতিষ্ঠানটি এবার পুঞ্জীভূত মুনাফা থেকে লভ্যাংশ দিয়েছে।

সুদ আয়ের বাইরে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের আয়ের বড় উৎস হচ্ছে পুঁজিবাজার। তবে ২০১৮ সালে পুঁজিবাজারে মন্দার কারণে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন সিকিউরিটিজের লেনদেন থেকে প্রাপ্ত মূলধনি মুনাফা, লভ্যাংশ আয় এবং সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের কমিশন ও ব্রোকারেজ আয় কমে গেছে প্রতিষ্ঠানটির।