পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে আইন মোতাবেক ২ শতাংশ শেয়ার নেই তাদেরকে বিনিয়োগকারীরা বাটপার পরিচালক হিসাবে আখ্যায়িত করেন। এই বাটপাররা কৌশলে দর বাড়িয়ে হাতে থাকা বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি করে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে কোম্পানির ওপর ছড়ি ঘুরান। বাজার নিয়ে ক্রাইসিস শুরু হলেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এই বাটপারদের চিহ্নিতকরণ এবং তাদের দ্বারা শেয়ার কেনানোর ভুয়া স্লোগান তুলতেন। এতে এ দেশের নিরীহ বিনিয়োগকারীগণ বাকবাকুম করে ওই শেয়ারে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। ফলে ওই সব কোম্পানির দাম বেড়ে যেতো আরো একধাপ। এভাবেই চলে আসছে যুগের পর যুগ। অদৃশ্য বাটপারদের সনাক্তকরন কিংবা তাদের পোর্টফোলিওতে ২ শতাংশ শেয়ার ধারন আর কোনো দিনও সম্ভব হয়নি। মুলত নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর ওদের প্রতি একটু অতিরিক্ত মায়ামহব্বতেই এ কাজগুলো হয়েছে। এখনেই শেষ নয়- যেসব বাটপারের প্রতি নিয়ন্ত্রকদের মায়ামহব্বতের পরিমাণ একটু বেশি হয় তারা চিরদিনের জন্য গায়েব হয়েও যেতে পারেন। চোখের সামনে থাকলেও তাদের ঠিকানা খুঁজে পায়না নিয়ন্ত্রকরা। হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে দিলো শতশত লোকের অন্তত ২ বছরের শ্রমের বিনিময়ে। (কারণ একটি কোম্পানি বাজারে আনতে ইস্যু ম্যানেজার, আন্ডার রাইটার অডিটর এক্সচেঞ্জসমুহ থেকে শুরু করে প্রচুর সংখ্যক লোকের সংশ্লিষ্টতা প্রয়োজন।) অথচ শুধু একটু মহব্বতের জন্য প্রথমে জেড গ্রুপ পরে ওটিসি সবশেষে ডিলিস্ট হয়ে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি জমায় এই বাটপারদের কোম্পানি। এক সময় বাজার মাতিয়ে রাখা কয়েকটি কোম্পানির নাম আমি আপনাদের শোনাতে চাই-যেমন আশরাফ টেক্সটাইল, ঈগল স্টার, রুপন অয়েল, চিক টেক্সটাইল ইত্যাদি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই কোম্পানিগুলোর নামও জানেন না। এ ধরনের অন্তত ৫০টি কোম্পানিকে বাজার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে দু:খে কষ্টে না খেয়ে বেশ কিছু বিনিয়োগকারী মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করেছেন। তারপরও থেমে থাকেনি বাটপার কোম্পানিগুলোর শেয়ারহীন মালিকানার প্রতারণামূলক দৌরাত্ম।

আশার কথা এবারের টানা ধসের কারণে আবার জাগ্রত হয়েছে আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাটপার কোম্পানিগুলোকে সনাক্ত করনের জন্য এবং বাটপারগুলোকে শাস্তির আওতায় আনতে তোড়জোড় শুরু করেছে। এটার জন্য নাকি কমিটিও করা হয়েছে। কিন্তু আমরা পত্রিকাওয়ালারা প্রতিনিয়ত এদের চিহ্নিত করে জনসম্মুখে হাজির করছি। তারা চাইলেই এদের শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু মিল মোহব্বতের বিষয়টি তো দেখতে হবে। কার সাথে কতটুকু মিল মহব্বত আছে তা বিবেচনা করেই হবে শাস্তির বাস্তবতা। তারপরও নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য আমরা ৪৭ কোম্পানির একটি তালিকা প্রকাশ করলাম। নিয়ন্ত্রকদের ঘোষণা অনুযায়ী ন্যূনতম শেয়ার না থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিচালক পদ বাতিল করা হবে এসব বাটপারের। শোনা যাচ্ছে, এসব পরিচালকদের শেয়ার ধারণসহ বিএসইসির নীতিমালা অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স না হওয়া কোম্পানির লেনদেনে আলাদা বোর্ড গঠনেও একমত হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এজন্য একটি খসড়াও চূড়ান্ত করেছে। আরও পর্যালোচনা শেষে খুব শিগগিরই তা নোটিফিকেশন আকারে প্রকাশ করা হবে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের স্বার্থে এমন উদ্যোগ প্রসংশনীয়। এটি পুরোপুরি প্রয়োগ হলে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। বিনিয়োগকারীর আস্থা ফেরাতে এ উদ্যোগ বার্তা হিসেবে কাজ করবে। এছাড়াও আরও যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে আগামী দিনে পুঁজিবাজার একটি শক্তিশালী ভিত্তের ওপর দাঁড়াবে বলেও মনে করছেন তারা।

জানা গেছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে যাদের বিএসইসির নীতিমালা পরিপালন (কমপ্লায়েন্স) করবে না, তাদেরও এই বোর্ডে স্থানান্তর করা হবে। এজন্য বিএসইসির পক্ষ থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) বলা হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জের প্রস্তুতি নেওয়ার পরই এটি বাস্তবায়ন হবে। এজন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির তথ্য যাচাই-বাছাই করবে স্টক এক্সচেঞ্জগুলো। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকদের ন্যূনতম ২ শতাংশ এবং উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে বাধ্যতামূলক ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হয়। কিন্তু আমাদের উল্লিখিত এই ৪৭টি কোম্পানি এ বিষয়টি পরিপালন করছে না। কয়েকটি কোম্পানিতে পরিচালকদের শেয়ার রয়েছে মাত্র পাঁচ শতাংশ। কিছু ক্ষেত্রে পরিচালকদের দুই শতাংশ শেয়ার না থাকলেও তারা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। কাজেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ২সিসি এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯ এর ক্ষমতা বলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটাই আমরা আশা করবো এবং এবারে অন্তত মহব্বতের বিষয়টিকে দূরে রাখবেন তাও আশা করবো।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, উদ্যোক্তা ও পরিচালক সম্মিলিতভাবে নূন্যতম শেয়ারধারণে সবচেয়ে বড় ব্যর্থ কোম্পানি ফাইন ফুডস লিমিটেড। এ কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার রয়েছে মাত্র ১.০৯ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে থাকা ইনটেক অনলাইন উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার রয়েছে ৩.৯৭ শতাংশ। তেমনি ভাবে ফ্যামিলি টেক্স বিডির উদ্যোক্তা পরিচালকদের রয়েছে ৪.০২ শতাংশ এবং ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ারধারণ রয়েছে মাত্র ৪.১৬ শতাংশ।

নিম্নে পদ হারানোর ঝুঁকিতে থাকা কোম্পানিগুলোর সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হল:

ক্রম কোম্পানি উদ্যোক্তা/
পরিচালক
যোগ্য
বিনিয়োগকারি
বিদেশি সাধারণ
ফাইন ফুডস ১.০৯% ০.০১% ৯৮.৯%
ইনটেক অনলাইন ৩.৯৭% ১০.৭৫% ৮৫.২৮%
ফ্যামিলি টেক্স ৪.০২% ১৮.৪১% ৭৭.৫৭%
ইউনাইটেড এয়ার ৪.১৬% ১৩.৫৩% ১২.১৮% ৭০.১৩%
ফু-ওয়াং সিরামিক ৫.৩৩% ৩৩.৪৬% ০.৪% ৬০.৮১%
ফু-ওয়াং ফুডস ৫.৩৬% ১৫.৬৯% ০.২৯% ৭৮.৬৬%
আইএফআইসি ব্যাংক ৮.৩৩% ২০.৪৪% ১.৮৫% ৩৬.৬৩%
অগ্নি সিস্টেমস ৯.৩৯% ৩৭.৭৬% ৫২.৮৫%
সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ ৯.৯% ১৫.৫% ৭৪.৫১%
১০ একটিভ ফাইন ১২.০৪% ২৮.৩৭% ৩.১১% ৫৬.৪৮%
১১ বেক্সিমকো ফার্মা ১৩.১৯% ৩২% ৩৮.৫৬% ১৬.২৫%
১২ ফাস ফাইন্যান্স ১৩.২% ১৬.৬৩% ৭০.১৭%
১৩ জে নেক্সট ১৩.৮২% ২৪.৬% ৬১.৫৮%
১৪ বিজিআইসি ১৪.৮৯% ৪০.৮% ৪৪.৩১%
১৫ নর্দার্ন জুট ১৫.২৭% ৮৪.৭৩%
১৬ আলহাজ্ব টেক্স ১৬.৮১% ৮.৮৩% ৭৪.৩৩%
১৭ মিথুন নিটিং ১৭.২% ১২.৪% ৭০.৪%
১৮ ইস্টার্ন কেবলস ১৭.৭৭% ১৬.৬৪% ১৪.৫৯%
১৯ পিপলস ইন্স্যুরেন্স ১৭.৮৯% ৩০.৩৯% ৫১.৮২%
২০ ডেল্টা স্পিনার্স ১৮% ১৬% ৬৬%
২১ মেঘনা লাইফ ১৮.০৭% ৩২.৫৭% ৪৯.৩৬%
২২ অ্যাপেক্স ট্যানারি ১৯.৪২% ৩৯.০৩% ৪১.৫৫%
২৩ বেক্সিমকো ২০.১৫% ২২.২৬% ৮.০৫% ৪৯.৪৯%
২৪ অ্যাপেলো ইস্পাত ২০.২৪% ২১.২৮% ০.৭৮% ৫৭.৭%
২৫ ওএএল ২০.৬৮% ২০.৬৪% ৫৮.৬৮%
২৬ উত্তরা ব্যাংক ২০.৮৮% ১৯.১৪% ২.৫২% ৫৭.৪৬%
২৭ দুলামিয়া কটন ২১.০৪% ৩.৪% ৭৫.৫৬%
২৮ ইনফরমেশন সার্ভিস ২১.৬২% ৮.৪১% ৬৯.৯৭%
২৯ সিএনএ টেক্সটাইল ২২.১৪% ১৫.৬৭% ৬২.১৯%
৩০ স্যালভো কেমিক্যাল ২২.১৪% ১৫.৩৭% ৬২.৪৯%
৩১ বিডিকম ২৩.১% ২৬.১৩% ৫০.৭৭%
৩২ পিপলস লিজিং ২৩.২১% ৮.৮২% ০.১৯% ৬৭.৭৮%
৩৩ জাহিন স্পিনিং ২৩.৯৪% ২৭.২২% ৪৮.৮৪%
৩৪ কে অ্যান্ড কিউ ২৪.০৬% ৩.৮৪% ৭২.১%
৩৫ ফার্মা এইডস ২৪.২২% ৩.৩৮% ৭২.৪%
৩৬ সেন্ট্রাল ফার্মা ২৫.৮৯% ১৬.০৮% ৫৮.০৩%
৩৭ মেট্রো স্পিনিং ২৬.২৩% ৭.৯২% ৬৫.৮৫%
৩৮ অলিম্পিক ২৭.৭৭% ১৫,৯৭% ৩৯.৮৪% ১৬.৪৩%
৩৯ বিডি থাই ২৮.২৩% ১৮.৫৯% ০.৯১% ৫২.২৭%
৪০ বে-লিজিং ২৮.২৮% ৩৭.২২% ০.৩৪% ৩৪.১৮%
৪১ ম্যাকসনস স্পিনিং ২৮.৩৭% ৯.৮৫% ৬১.৭৮%
৪২ আফতাব অটোস ২৮.৪২% ৩৮.৭% ৩২.৮৮%
৪৩ এমারেল্ড অয়েল ২৮.৪২% ৮.৯৮% ৬২.৬%
৪৪ স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক ২৮.৫% ৩.১২% ৬৮.৩৮%
৪৫ পপুলার লাইফ ২৮.৯২% ৭.৭% ০.২১% ৬৩.১৭%
৪৬ তাল্লু স্পিনিং ২৯.০৪% ১৭.০৩% ৫৩.৯৩%
৪৭ কনফিডেন্স সিমেন্ট ২৯.৮৮% ২৭.২৮% ৪২.৮৪%