উইজার্ড অব ওমাহা ওয়ারেন বাফেট বহুজাতিক কনগ্লোমারেট বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের নেতৃত্বে আসেন ১৯৬৪ সালে। ওই সময়ের পর থেকে ৫৪ বছরে শেয়ারহোল্ডারদের মাত্র একবারই লভ্যাংশ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ পরিশোধের বদলে অবণ্টিত মুনাফাকে পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধিতে বিশ্বাসী ওয়ারেন বাফেট। এর মধ্য দিয়ে নগদ লভ্যাংশ না পেলেও শেয়ারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে আরো বেশি লাভবান হয়েছেন শেয়ারহোল্ডাররা। অন্যদিকে এ সময়ের মধ্যে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে পরিণত হয়েছে মহীরুহে।
প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডারদের দেয়া বাফেটের চিঠির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৫ থেকে সর্বশেষ ২০১৮ সাল পর্যন্ত বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের শেয়ারের বুক ভ্যালুর বিপরীতে বার্ষিক মুনাফার চক্রবৃৃদ্ধি হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। আর বাজারমূল্যের ভিত্তিতে এ চক্রবৃদ্ধি মুনাফার হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। এসঅ্যান্ডপি-৫০০ সূচকে লভ্যাংশসহ বিনিয়োগকারীদের চক্রবৃদ্ধি মুনাফা হয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে ১৯৬৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বুক ভ্যালু হিসেবে কোম্পানিটির সার্বিক মুনাফা হয়েছে ১০ লাখ ৯১ হাজার ৮৯৯ শতাংশ। বাজারমূল্যের ভিত্তিতে এ হার দাঁড়ায় ২৪ লাখ ৭২ হাজার ৬২৭ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে এসঅ্যান্ডপি-৫০০ সূচকে লভ্যাংশসহ বিনিয়োগকারীদের সার্বিক মুনাফা হয়েছে ১৫ হাজার ১৯ শতাংশ।
এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ পরিশোধ করা হয়েছে একবারই, ১৯৬৭ সালে। বিষয়টি নিয়ে বাফেট নিজেই পরে কৌতুক করে বলেছেন, সিদ্ধান্তটি সম্ভবত বাথরুমে বসে নেয়া হয়েছিল।
ব্যবসায়িক অনন্যতা ও মুনাফাযোগ্যতার দিক থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সুনাম রয়েছে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের। ওয়ারেন বাফেটের নেতৃত্বগুণে গোটা বিশ্বের ব্যবসায়িক সব প্রতিষ্ঠানের কাছেই এখন ঈর্ষণীয় একটি নামে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কনগ্লোমারেট প্রতিষ্ঠানটি। বীমা, উড়োজাহাজ পরিবহন, পোশাক, আবাসন, জুয়েলারি, সংবাদমাধ্যমসহ নানা ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) ওয়ারেন বাফেটকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারীদের একজন। ব্লুমবার্গের বিলিয়নেয়ার ইনডেক্স অনুসারে ওয়ারেন বাফেট বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ ধনী। তার সম্পদের পরিমাণ ৮ হাজার ৩৭০ কোটি ডলার।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মিত ও সর্বোচ্চ ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রীতিমতো সোনার ডিম পাড়া হাঁস বলে বিবেচনা করেন ওয়ারেন বাফেট। এজন্য পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বার্কশায়ারের প্রধান লক্ষ্যও থাকে এসব প্রতিষ্ঠান। যদিও নিজের শেয়ারহোল্ডারদেরই লভ্যাংশ দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টিকে স্ববিরোধী মনে হলেও এর মধ্যেও রয়েছে বাফেটের প্রতিভার পরিচয়।
লভ্যাংশ না পেলেও বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের দীর্ঘমেয়াদি শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা অনুযোগ নেই। কারণ লভ্যাংশ না দিলেও বার্কশায়ারের শেয়ারের মূল্য বরাবরই আকাশচুম্বী। বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ পরিশোধের বদলে অবণ্টিত মুনাফা পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে কোম্পানির সম্পদ বাড়িয়ে চলেছেন ওয়ারেন বাফেট। কোম্পানির সম্পদমূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকায় শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানাধীন শেয়ারের ভ্যালুও বেড়ে চলেছে বিরামহীনভাবে। ফলে বিষয়টিতে খুব একটা আপত্তি নেই তাদেরও।
ওয়ারেন বাফেট মনে করেন, ডিভিডেন্ড পরিশোধের বদলে কোম্পানির আয়কে এমনভাবে কাজে লাগানো সম্ভব, যাতে বিষয়টি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য আরো লাভজনক হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে মুনাফাকে এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে, যাতে কোম্পানির দক্ষতা ও কার্যপরিধি বাড়ে, প্রডাক্ট লাইন আরো প্রসারিত হয় (অর্থাৎ, পণ্য ও সেবার সংখ্যা বাড়ে), বিদ্যমান পণ্য ও সেবার মান বাড়ানো যায় এবং সর্বোপরি ব্যবসায়িক প্রতিযোগীদের তুলনায় নিজেকে আরো সক্ষম ও স্বতন্ত্র করে তোলা যায়।
সরাসরি লভ্যাংশ পরিশোধের বদলে মুনাফার অর্থ ব্যবসায় পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে শেয়ারহোল্ডারদের ভ্যালু দীর্ঘমেয়াদে আরো অনেক বেশি বাড়ানো সম্ভব বলেই মনে করেন বাফেট। এক্ষেত্রে তার যুক্তি হলো, কোম্পানির আর্থিক সাফল্যে শেয়ারহোল্ডারদের স্টক ভ্যালু বাড়ে।
বাফেটের নিজের ভাষায়, একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের উচিত প্রথমে এর বিদ্যমান ব্যবসায় পুনর্বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখা। এর মধ্য দিয়ে ব্যবসায়িক প্রকল্পগুলো আরো দক্ষ হয়ে উঠবে, কার্যপরিধি বাড়বে, প্রডাক্ট লাইন সম্প্রসারিত ও আরো মানসম্পন্ন হয়ে উঠবে অথবা নিদেনপক্ষে কোম্পানির জন্য এমন একটি ‘ইকোনমিক মোট’ তৈরি হবে, যার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে ব্যবধান আরো সম্প্রসারিত হবে। লাভজনক পুনর্বিনিয়োগের ভালো সুযোগ থাকলে তাতে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য নগদ অর্থপ্রাপ্তির তুলনায় আরো ভালো সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে।
প্রসঙ্গত, ‘ইকোনমিক মোট’ একটি ব্যবসায়িক পরিভাষা, যাকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন ওয়ারেন বাফেট নিজেই। এর মাধ্যমে একটি ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদি মুনাফা ও বাজার অংশীদারিত্ব ধরে রাখার প্রতিযোগী সক্ষমতাকে বোঝায়।
পুনর্বিনিয়োগের এসব সুযোগ কাজে লাগানোর পর পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে বাফেটের বক্তব্য, পরবর্তী পদক্ষেপ হবে আমাদের বিদ্যমান ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যবসা অধিগ্রহণের সুযোগ খোঁজা। এক্ষেত্রে বিবেচনার বিষয় হলো, এতে শেয়ারহোল্ডারদের অবস্থা অধিগ্রহণের আগেকার সময়ের তুলনায় আরো ভালো হবে কিনা।
এ দুই পদক্ষেপ সফলভাবে সম্পন্নের পর তৃতীয় পর্যায়ে বিবেচনার বিষয় হলো স্টক পুনঃক্রয়। এক্ষেত্রে রক্ষণশীলভাবে হিসাবের পর কোম্পানির শেয়ারের যে ভ্যালু দাঁড়ায়, তার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে ডিসকাউন্টে বিক্রি হলেই এ স্টক পুনঃক্রয়ের বিষয়টিকে বিচক্ষণ বলা চলে।
ডিভিডেন্ড যে শেয়ারহোল্ডারদের আয় বাড়ানোর একটি উপায়, বাফেট নিজেও তা স্বীকার করেন। তবে এক্ষেত্রেও প্রয়োজন হলে সমপরিমাণ আয়ের জন্য শেয়ারহোল্ডাররা তাদের স্টকের একটি অংশ বিক্রি করে দিতে পারেন বলে মনে করেন তিনি। এজন্য বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে বাজার থেকে সময়ে সময়ে তার শেয়ার বাই ব্যাক করে। ওয়ারেন বাফেটের মতে, এটি যেসব শেয়ারহোল্ডার কোম্পানি ছেড়ে চলে যেতে চান, তাদের জন্য ভালো আবার কোম্পানির বর্তমান শেয়ারহোল্ডারদের জন্যও ভালো।
ওয়ারেন বাফেট নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় সামনের দিনগুলোতেও বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ পরিশোধের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণের পাশাপাশি কর এড়ানোর জন্যও লভ্যাংশ পরিশোধের বদলে গ্রহণেই আগ্রহ বেশি বাফেটের।
অবণ্টিত মুনাফাকে লভ্যাংশ পরিশোধের বদলে কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজে লাগানোর বিষয়টি যে বেশি লাভজনক, বার্কশায়ারের পরিসংখ্যানও সে কথাই বলে। স্টক এক্সচেঞ্জে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের এ ও বি ক্যাটাগরির দুই ধরনের শেয়ার রয়েছে। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির এ ক্যাটাগরি শেয়ার সর্বোচ্চ ৩ লাখ ১৩ হাজার ৩৫০ লাখ ডলারে লেনদেন হয়েছে। এ প্রতিবেদন লেখাকালীন কোম্পানিটি এ ক্যাটাগরির শেয়ার নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বশেষ ৩ লাখ ৮ হাজার ৫০৪ ডলারে লেনদেন হয়েছে।
বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের গত ১০ বছরের আর্থিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৮ সালে কোম্পানিটির মোট সম্পদ ছিল ২৬ হাজার ৭৩৯ কোটি ডলার, যা ২০১৮ শেষে ৭০ হাজার ৭৮০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০০৮ সালে কোম্পানিটির রেভিনিউ ছিল ১০ হাজার ৭৭৮ কোটি ডলার, যা ২০১৮ সালে এসে ২৪ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার হয়েছে। ২০০৮ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের নিট আয় ছিল ৪৯৯ কোটি ডলার, যা ২০১৮ সাল শেষে ৪০২ কোটি ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে ক্রাফট হেইঞ্জে বিনিয়োগে লোকসানের কারণে গত বছর বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের শেয়ারে বড় দরপতন ঘটে।