বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের সিদ্ধান্তের খবরে কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য সালমান ফজলুর রহমানকে ইংগিত করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) যে বিবৃতি দিয়েছে, তাকে ‘অবমাননাকর’ হিসেবে বর্ণনা করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এই শিল্প গ্রুপ।

বেক্সিমকো চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান রোববার টিআইবি চেয়ারপারসন সুলতানা কামালকে দেওয়া এক চিঠিতে এই প্রতিবাদ জানান। সকালে ধানমণ্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে গিয়ে ওই চিঠি হস্তান্তর করেন বেক্সিমকো গ্রুপের পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী।

বেক্সিমকো গ্রুপের ৪৩০.০৫ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের আবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের একটি খবর গত ১৩ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার। ওই খবরের প্রতিক্রিয়ায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ওইদিনই একটি বিবৃতি দেন, যা পরদিন ডেইলি স্টারে ছাপা হয়।

সোহেল এফ রহমান তার চিঠিতে লিখেছেন, “বেশ কিছু আপত্তিকর অভিযোগের পাশাপাশি ডেইলি স্টারে টিআইবি নির্বাহী পরিচালকের একটি উদ্ধৃতি প্রকাশ করা হয়েছে: ‘ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে একদল লুটেরা আইনপ্রণেতা হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেছে।’

“টিআইবির বিবৃতিতে যেহেতু বেক্সিমকো গ্রুপের অনুকূলে ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের একটি ঘটনা প্রাধান্য পেয়েছে, সেহেতু এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, নির্বাহী পরিচালক ওই মন্তব্য করেছেন আমাদের গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান ফজলুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে, যিনি গত নির্বাচনে ঢাকা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের ওই ‘লুটেরা’ সম্বোধনে ‘অত্যন্ত অপমানিত’ বোধ করার কথা জানিয়ে বেক্সিমকো চেয়ারম্যান লিখেছেন, “এই মন্তব্য শুধু আমাদের ভাইস চেয়ারম্যানের জন্যই মর্যাদাহানিকর নয়, বরং সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা ঋণ পুনঃতফশিল করেছেন ও আমাদের গ্রুপের ৬০ হাজার কঠোর পরিশ্রমী কর্মীর জন্যও অবমাননাকর।”

টিআইবির বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে বেক্সিমকো গ্রুপের ‘দীর্ঘ সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক’ রয়েছে মন্তব্য করে চিঠিতে বলা হয়েছে, টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের এ ধরনের ‘আপত্তিকর ইঙ্গিতপূর্ণ’ মন্তব্য অনভিপ্রেত এবং টিআইবি ও সংস্থাটির বর্ণিত মূল্যবোধের জন্য ‘অমর্যাদাকর’।

১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো গ্রুপ বাংলাদেশে বৃহৎ শিল্পের বিকাশে কীভাবে অবদান রেখে চলেছে, তার একটি বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে টিআইবিকে দেওয়া চিঠিতে।

সেখানে বলা হয়, সালমান এফ রহমান দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে বিগত দিনে বিএনপি সরকারের সময় এবং পরে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বেক্সিমকো ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চরম বৈষম্যমূলক আচরণের’ শিকার হয়।

“ওই সময় আমাদের গ্রুপে ঋণ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমাদের ভাইস চেয়ারম্যানকে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা হয়, যেটি আইনের আদালতে পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।”

“এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্দেশ্য ছিল দেশে অরাজনীতিকরণ কায়েম করা। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সফল ব্যবসায়ীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয় এবং জীবন ও ব্যবসা রক্ষার বিনিময়ে বিপুল অঙ্কের চাঁদার অর্থ পরিশোধে বাধ্য করা হয়।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কয়েকজন ক্ষমতাসীন ব্যক্তির ওই ‘অবৈধ চাঁদাবাজির’ সমালোচনা টিআইবি কখনও করেছে কি না, সেই প্রশ্ন রাখা হয়েছে বেক্সিমকোর চিঠিতে।

বেক্সিমকোকে কেন ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের আবেদন করতে হল, তার একটি ব্যাখ্যাও চিঠিতে দেওয়া হয়েছে।

সেখানে বলা হয়, বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় টানা সাত বছর বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নেতিবাচক পদক্ষেপ’ নেওয়া হয়েছে। আর্থিক প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কোম্পানির ফার্মাসিউটিক্যাল শাখাকে প্রায় দুই বছর এলসি খুলতে দেওয়া হয়নি।

“এই ধারাবাহিক বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে কোম্পানির মধ্যে তারল্য সংকট দেখা দেয়। যার ফলে আমরা সময় মত ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতে সমর্থ ছিলাম না।… আমাদের মত একটি বড় কোম্পানির জন্য এই পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক ছিল যে আমরা এখনও সেখান থেকে পুরোপুরি সেরে উঠতে পারিনি।”

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত ১১ বছরে বেক্সিমকো বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে দাবি করে চিঠিতে বলা হয়, “এ কারণেই বিভিন্ন ব্যাংকে আমাদের অ্যাকাউন্ট এখন নিয়মিত ও অশ্রেণিভুক্ত অবস্থায় আছে। সুতরাং টিআইবির বিবৃতিতে বেক্সিমকোকে ‘শীর্ষ ঋণখেলাপি’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ায় আমরা ভীষণ বিস্মিত হয়েছি।”

সোহেল এফ রহমান লিখেছেন, প্রথমবার তাদের ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের অনুমোদন পাওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি ‘স্বাধীন ও অনুমোদিত’ অডিট ফার্মকে দিয়ে বেক্সিমকোর সম্ভাব্য অর্থ প্রবাহ নিরীক্ষা করা হয়েছিল। ওই অডিট ফার্ম জানিয়েছিল, পুরো ঋণ পরিশোধ করতে বেক্সিমকোর ১২ বছর সময় লাগতে পারে।

“কিন্তু বাংলাদেশ ব্যংক আমাদের ঋণকে দুই ভাগে ভাগ করে- মেয়াদী ঋণ ও কার্যকরী মূলধন ঋণ। কার্যকরী মূলধন ঋণ পরিশোধের জন্য আমাদের ছয় বছর সময় দেওয়া হয়। তবে ওই সময়ই আমরা ব্যাংককে জানিয়েছিলাম যে, ছয় বছরের মধ্যে ওই ঋণ পরিশোধ করা আমাদের আর্থিক প্রবাহ অনুযায়ী সম্ভব নাও হতে পারে।

“এখন আমরা অনুমান করছি যে, বিদ্যমান আর্থিক প্রবাহ অনুযায়ী নিয়মমাফিক কিস্তি পরিশোধে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এ কারণেই আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রথম পুনঃতফশিলিকরণের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে স্বাধীন অডিট প্রতিষ্ঠানের মূল সুপারিশ পালন করার জন্য অনুরোধ জানাই।”

এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভায় বিষয়টি অনুমোদন করা হয় জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, নিয়মিত অ্যাকাউন্টধারী অন্যান্য ঋণগ্রহীতার ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

টিআইবি চেয়ারপারসনকে দেওয়া চিঠির শেষে বেক্সিমকো চেয়ারম্যান লিখেছেন, “টিআইবি দাবি করে তারা দেশে স্বচ্ছতা আনয়ন ও আইনের শাসনের পক্ষে কাজ করে। কিন্তু মতামত-নির্ভর প্রতিবেদনের বরাতে যে বিবৃতি টিআইবি দিয়েছে ও নির্বাহী পরিচালক আমাদের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান ফজলুর রহমান এমপিসহ সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে যেই অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন, তা শুধু হতাশাজনকই নয়, তা আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতিও অমর্যাদাজনক।”