দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ এমনিতেই প্রত্যাশার তুলনায় কম। এ বিনিয়োগের প্রায় অর্ধেকই আবার আসে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবণ্টিত মুনাফা বা রিটেইনড আর্নিংস থেকে। অবণ্টিত এ মুনাফার ওপরই ১৫ শতাংশ করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। তারা বলছেন, পরোক্ষভাবে এ কর বিদেশী বিনিয়োগের ওপরই আরোপ করা হয়েছে।
ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো যে অর্থ বাংলাদেশে আনে, তার ভিত্তিতে এফডিআইয়ের পরিসংখ্যান ও গতিপ্রকৃতিসংবলিত তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিট নিজস্ব মূলধন বা ইকুইটি, আয়ের পুনর্বিনিয়োগ বা রিটেইনড আর্নিংস ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ বা ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন—এ তিন ভাগে এফডিআই-প্রবাহ হিসাব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদেশী বিনিয়োগসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত দেশে এফডিআই এসেছে ১ হাজার ১০৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে অবণ্টিত মুনাফা থেকেই হয়েছে ৫৪৯ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৪৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
অবণ্টিত এ মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ করারোপের প্রস্তাব করে প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারের অনেক কোম্পানির মধ্যে তাদের মুনাফার অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের না দিয়ে রিটেইনড আর্নিংস ও রিজার্ভ হিসেবে রেখে দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এতে শেয়ারহোল্ডাররা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি পুঁজিবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে বাজেটে কোনো কোম্পানির অবণ্টিত মুনাফা ও সঞ্চিতির পরিমাণ যদি এর পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হয়, তবে সেক্ষেত্রে যতটুকু বেশি হবে, তার ওপর কোম্পানিকে ১৫ শতাংশ কর প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এ ১৬(জি) নামে একটি নতুন ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।
এ প্রস্তাবের সমালোচনা করে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি (বিএটিবিসি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনিম গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, আজ (সোমবার) সকালেই বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যানকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছি। তাকে বলেছি, আমরাই বিশ্বের প্রথম দেশ, যারা এফডিআইয়ের ওপর করারোপ করেছি। কারণ বাংলাদেশে এফডিআইয়ের বৃহৎ অংশ রিটেইনড আর্নিংস, যার সবই বৃহৎ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি রিটেইনড আর্নিংসের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে বলা হয়, তাহলে তারা খুব সম্ভব জরুরি সাধারণ সভা ডেকে সব ডিভিডেন্ড বিতরণ করবে। এরপর বিদেশে তাদের শেয়ারহোল্ডারদের প্রায় বিলিয়ন ডলার দিতে হবে। এ সামর্থ্য কি তাদের আছে?
এ সমস্যায় পড়তে হবে তামাক খাতের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বিএটিবিসিকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির এফডিআই-প্রবাহ ছিল ৪ কোটি ১৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এ প্রবাহের পুরোটাই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির অবণ্টিত মুনাফা। প্রস্তাবিত বাজেটের ঘোষণা অনুযায়ী এ মুনাফার ওপর বিএটিবিসিকে ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে মোট বিদেশী বিনিয়োগের মধ্যে নিজস্ব মূলধন বা ইকুইটির পরিমাণ ৩৪৪ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। আর আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ বা ইন্ট্রা-কোম্পানি লোনের পরিমাণ ২১৫ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার ডলার। আর রিটেইনড আর্নিংসের পরিমাণ ৫৪৯ কোটি ৪৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। এ হিসাবে মোট এফডিআই-প্রবাহের প্রায় অর্ধেকই রিটেইনড আর্নিংস।
এর ওপর করারোপের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে এফডিআই-প্রবাহের সিংহভাগই রিটেইনড আর্নিংস। পুনর্বিনিয়োগ হয় মুনাফা থেকে। এখন মুনাফা থেকে ডিভিডেন্ড দিয়ে দিতে হলে বিদেশী বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ কীভাবে হবে? আর বিদেশী প্রতিষ্ঠান যখন ডিভিডেন্ড দেবে, তখন তা দেবে বিদেশী মুদ্রায়। অর্থাৎ বিদেশী কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের টাকা দিয়ে দিতে হবে। গত পাঁচ বছরের এফডিআই-প্রবাহের হিসাবে প্রায় ৫০ শতাংশ যদি এই করের কারণে দিয়ে দিতে হয়, তাহলে দেশের অর্জন কী হবে? ডিভিডেন্ডের পরিমাণ যা-ই হোক, যেটা অবণ্টিত রাখবে, তার ওপর কর দিতে হবে। আর সে ট্যাক্স কি কেউ দিতে চাইবে? এ পরিস্থিতিতে কেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইবেন?